Skip to content

২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শীর্ষেন্দুর ‘জবা’: গ্রামীণ নারীর প্রতিচ্ছবি

প্রথিতযশা ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ( ২ নভেম্বর ১৯৩৫)। তিনি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদান রেখেছেন গল্প, উপন্যাস, সিরিজ, শিশুতোষ গল্প রচনার মাধ্যমে। তার অনবদ্য সাহিত্য সম্ভার তাকে সাহিত্যাকাশের উচ্চমার্গে স্থান দিয়েছে। তার একটি শিশুতোষ গল্প ‘গয়ানাথের হাতি’। এ গল্পটি সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে লেখকের বর্ণনাভঙ্গির সুকৌশলে।

গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র গয়ানাথ। এছাড়া গল্পটিতে স্থান পেয়েছে জবা, জপেশ্বর সাধুখাঁ, ভগবান, ধানেশ বৈরাগী। গল্পের প্রধান চরিত্র গয়নাথের বড় শখ সে হাতি কিনবে। হাতির পিঠে করে সারা গ্রাম ঘুরবে। একসময় গাঁয়ের মগনলালের হাতি ছিল। হাতিতে চেপে সে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতো। হাতির ঠমক চমকই আলাদা। ঘোড়া বা গাধাতে সে শখ কিছুতেই পূরণ হয় না। হাতির পিঠে চড়লে সবাই তাকায় কিন্তু অন্য পশু তো নেহায়েত বোকামি। কিন্তু গয়ানাথের হাতি কেনার শখ থাকলেও সাধ্য নেই। নুন আনতে যার পানতা ফুরোয়, তার আবার হাতির শখ!

চাষবাস করে যে ফসলটুকু হয় তা একটুও ঘরে ওঠে না। ধার-কর্য মেটাতেই সব শেষ হয়। কিন্তু সেসব নিয়ে গয়ানাথের দুঃখও নেই, দুশ্চিন্তাও নেই। তার শুধু একটায় সাধনা, কিভাবে সে হাতি কিনবে। গ্রামের জপেশ্বর সাধুখাঁ তার গাই কিনতে উপদেশ দেয়। দরিদ্রের ঘরে দুধও আসবে আর তার শখও মিটবে। কিন্তু গয়ানাথের তো আর হাতির শখ মিটবে না। চুপ করিয়ে দেয় সবাইকে। যেই তাকে জ্ঞান দিক না কেন সে জানে তার হাতিই লাগবে। ধানেশ বৈরাগী বলে হাতির কত খাবার লাগে, তার পেট কত বড়। তুই খাওয়াবি কী!

এই গয়ানাথের বউ জবা। সে বড্ড ধার্মিক। পুজো-আচ্চা-ব্রত-পার্বণ-উপবাস করে তার দিন চলে। স্বামীর এই পাগলামোকে সে প্রশ্রয় দেয় না। ছেলেপিলে নিয়ে ঘর করে সে। হাতির নিচে পড়ে মরবে কখন তারা সেই ভয় তার। স্বামীকে উপদেশ দেয় হাতির চিন্তা ছেড়ে ভগবানকে ডাকো। দু বেলা দুমুঠো ভাত জোটে না হাতির স্বপ্নে বিভোর! গয়ানাথ তো এবার থমকে দেয় জবাকে। ‘গয়নাথ অবাক হয়ে বলে, তাকে আবার ডকাডাকির কী আছে। তার সঙ্গে তো আমার নিত্যি দেখা হয়।’ জবার তো আক্কেলগুড়ুম! বলে কী তার স্বামী। মাথা তার নষ্ট হয়নি তো। জবা বেশ বুদ্ধিমতি। স্বামীকে কিভাবে জব্দ করতে হয়, সে তা জানে। জবা স্বামীর এই পাগলামোকে প্রশ্রয় দেয় না। গয়নাথ বোকা, অতি সরল। তার দুঃখ ঘোচানোর তেমন কোনোই ইচ্ছা নেই। সে শুধু চায় তার হাতি। কিন্তু জবা তো চায় অঢেল সম্পত্তি।

গয়ানাথ যে মাঠে কাজ করে সেখানে বটগাছ তলায় ভগবান নামে একজনের সঙ্গে তার রোজ দেখা হয়। বউকে বলতেই সে তেড়ে ওঠে। কিন্তু গয়নাথ ভগবানের কাছে তার হাতির মনোকামোনা জানাতেই ভগবান তাকে একটা বেলুন দিলো। সেটাকে হাতির মতো বড় করে ফুলাতে বলে। গয়নাথ খুব খুশি এ তো সত্যিই হাতি! জবা বুদ্ধিমান, চতুর। ফলে স্বামী গয়নাথ তাকে যতই ভগবানের গল্প বলুক না কেন সে কিছুতেই বিশ্বাস করে না। একদিন হঠাৎ গয়ানাথ হাতি নিয়ে হাজির।

তাহলে চারিদিকে নেই নেই হাহাকার হলেও নিজের মনের সুখ নষ্ট হবে না। কম চাহিদা জীবনে সুখের অন্যতম চাবিকাঠি। নাহলে গয়ানাথের হাতি পাওয়ার পর ধীরে ধীরে জবার মতো সম্পদের মোহ বাড়তেই থাকবে। কোনোদিন সেই স্বপ্নও পূরণ হবে না। মনের শান্তিও ফিরবে না।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় রূপকের সাহায্যে মানবজীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা-লোভের ওপর রেশ টেনেছেন। আসলে আদতে ভগবান তাকে দিয়েছে একটি বেলুন। যে বেলুন ফুলে হয়েছে হাতির মতো। পৃথিবীতে সবই বেলুনের মতো। যত ফুঁ দেয় ততই ফোলে। বেলুন ফুলে যে হাতির মতো তা নিয়ে তো কোনো ঝামেলা হবে না। তাকে খাওয়ানোর সমস্যা নেই। একটু হাওয়া ছেড়ে দিলেই সে ছোট আকার হবে। তখন সে বাচ্চা হাতি হবে। বউ ভয় পেলেও সে ছোট করে নিতে পারবে। এরকম হাতি পেয়ে গয়নাথ বেজায় খুশি। তবে জবা বুদ্ধিমতি, সে তো স্বামীর হাতি চায় না। সে চায় টাকা। প্রচুর টাকা। ধন-রত্নের ভাণ্ডার। গয়ানথের হাতি পাওয়ার খবর গ্রামে-শহরে রটে যেতেই। এক একজন একেকে কথা বলে। শেষমেশ মোড়ল-মাতবরেরা তার কুড়িয়ে পাওয়া সোনার ভাণ্ডার কোথায় রেখেছে, এ নিয়ে শাসাতে থাকে। এদিকে জবা মহাখুশি।

জবার চরিত্রটিকে ধার্মিক করে তুলেছেন লেখক। তবে তার মধ্যে লোভের যে সীমা নেই, সেটিও দেখিয়েছেন। গয়ানাথ বউ যা বলে সে অনুযায়ী পথ চলে। বউ তাকে বললো ভগবানের কাছ থেকে হাতি নিলে চলবে না। সুযোগ কেন হারাবে। জবার মধ্যে লোভাতুর মনোভাব। সে স্বামীকে বলে,

‘ওগো ভগবানের সঙ্গে যখন তোমার এতই ভাব তখন আর একটু চেয়েই দ্যাখো না! আমাদের তো এত অভাব। শুধু হাতি হলেই তো চলবে না।

তা কী চাইবো বলো?
এই একখান সাতমহলা বাড়ি, সাত ঘড়া মোহর, সাত কলসি হীরে-মুক্তো।’

গয়ানাথ তো বউয়ের কথায় দিব্যি রাজি। জবার তো জীবনের সব পাওয়া পূরণ হবে। তার আকাঙ্ক্ষা বাড়তেই থাকে। গয়ানাথ ভগবানকে বলতেই সে বলে সাত মহলার জায়গায় চৌদ্দ মহলা, চৌষট্টি মহলা, সাত ঘড়ার জায়গায় সাতশ, সাত হাজার ঘড়া হীরে মুক্তো দেবো। গয়ানাথের খুশি কে দেখে। কিন্তু গয়নাথ তার বউয়ের মতো লোভীও নয় হিসেবিও না। ফলে ভগবানের এ শর্তে সে বেশ ঘাবড়ে যায়। এত সম্পদ সামলাবে কে? তখন সে অনেক সম্পত্তির মালিক। লোক রেখে দেখাশুনা করবে। কিন্তু গয়ানাথের তো বেজায় টেনশন। বউকে তার জানাতে হবে। জবার কথা ভগবান বটগাছ তলায় আর না বসলেও সমস্যা নাই। ভগবান দাদাকে না হয় সিংহাসন বানিয়ে দেবে।

কিন্তু সম্পত্তি সব চায়। পরদিন জবার কথা ফেলে সে বেলুনের হাওয়া খুলে ট্যাকে গুঁজে ভগবানের কাছে যায়। তার কিছু লাগবে না। শুধু ভগবান বটগাছ তলায় থেকে তাকে দর্শন দিক। সে পান তামাক সেজে দেবে। তাতেই তার খুশি।
জবার মধ্যে আছে লোভ। সম্পত্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ফলে ভগবানের দর্শন না পেলেও কিছু আসে যায় না। সে সম্পত্তি দিয়ে বিদায় হলেও সমস্যা নেই তার। জবা চতুর। পক্ষান্তরে গয়ানাথ নির্লোভ।

অর্থই যে অনর্থের মূল তা এ গল্পে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তার এক হাতি হতেই মোড়ল, মাতবরের তোপের মুখে পড়েছে। সবার চক্ষুশূল হয়েছে। বউ তাকে বেজায় খাতির করলেও হাতির শখেই গয়ানাথ জীবনের শিক্ষা নিয়েছে। যে যত পায় সে তত চায়। জবা যখন সাত ঘড়ার জায়গায় চৌষট্টি ঘড়া, সাত হাজার ঘড়া মুক্তো-হীরে পাচ্ছে তাও তার আকাঙ্ক্ষা মেটে না। মানব জাতি বড়ই অভাবনীয় জীব। যত বাড়বে থাকে তার লোভ, আশা, আকাঙ্ক্ষা আরও দ্বিগুণ, তিনগুণ, চতুর্গুণ হয়ে ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলে।

জবার চরিত্রটি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন লেখক। মানব জাতির এই জবা নামক চরিত্রের থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অল্পে তুষ্ট থাকার মহাসুখ অনুভবে অভ্যস্ত হতে হবে। তাহলে চারিদিকে নেই নেই হাহাকার হলেও নিজের মনের সুখ নষ্ট হবে না। কম চাহিদা জীবনে সুখের অন্যতম চাবিকাঠি। নাহলে গয়ানাথের হাতি পাওয়ার পর ধীরে ধীরে জবার মতো সম্পদের মোহ বাড়তেই থাকবে। কোনোদিন সেই স্বপ্নও পূরণ হবে না। মনের শান্তিও ফিরবে না।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ