বিনোদনের নামে যৌন-হয়রানি বন্ধ হোক
সুস্থ বিনোদন সুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক কিন্তু বর্তমানে সবক্ষেত্রেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। এমনকি বিনোদনের জগতটা আরও বেশি বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। মানুষ যত সভ্য হওয়ার তকমাধারী হচ্ছে তত নোংরামি বাড়ছে চারিদিকে। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে জীবনযাপনে এসেছে অনেকটা পরিবর্তন। মানুষ এখন বিশেষভাবেই ইন্টারনেটে ঝুঁকেছে। সময়-অসময় বলে কোনো কথা নেই; বরং মানুষের জীবনের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট।
যান্ত্রিক জীবনে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে মানুষ বেঁচে থাকার মূল রসদগুলো খোঁজার চেষ্টা করছে। যুগের পরিবর্তনের হওয়ায় মানুষ এখন অনেকটা বিচ্ছিন্ন। একে অন্যের সঙ্গে দুই মিনিট মন খুলে কথা বলার ভরসা-সাহস-শক্তি পায় না। ফলে বেশিরভাগেরই মনের খোরাক মেটায় ইন্টারনেট। কিন্তু এই ইন্টারনেট মানুষের জন্য কতটা নিরাপদ?
মানবজীবনে এর প্রভাব ভালো-মন্দ দুই দিকেরই আছে। তবে ভালোর সঙ্গে মানুষের সাক্ষাৎ খুব একটা বেশি বলে মনে হয় না। কারণ মানুষ মাত্রই কিছুটা পাশবিক। কিন্তু কেউ দমন করে। কেউ পারে না। তাই ভালোর তকমা তার জন্য আর কেউ সেই মন্দটাকে আরও উগ্র করে তোলে। খাবার যেমন অনিবার্য তেমনই মানুষের জীবনে ইন্টারনেটও অনিবার্য এখন। ফলে ভোজ্য যদি ভেজাল হয় তবে মানুষের রুচি-অভিরুচি-মন-মর্জি সবই বস্তাপচা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ইন্টারনেটের শাসনের যুগে মানুষ ভালোর চর্চার চেয়ে খারাপের পথেই বেশি হাঁটছে। তা সমাজ বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে একদৃষ্টে চোখে পড়বে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কথা হলো নারীরা বারবার শিকারে পরিণত হচ্ছে। সেটা বাস্তব সমাজে যেমন দৃশ্যমান তেমনই ইন্টারনেট দুনিয়ায়ও।
বিনোদনের নামে এখন ভাঁড়ামিতেই মানুষ বেশি অভ্যস্ত। নারীরাও হয়ে উঠেছে বিনোদন মাধ্যমগুলোর অন্যতম হাতিয়ার। টাকা কামানোর সস্তা পথ হিসেবে অনেকেই এই মাধ্যমগুলো ব্যবহার করছে অবলীলায়। কিন্তু বিনোদনের নামে নারীকে আর কত ব্যবহার করা হবে? বিনোদনের নামে নারীদের যৌন-হয়রানি কেন?
সংকট গড়ে ওঠে বিভিন্ন মাধ্যমে। বিনোদনের নামে নারীর যৌন-হয়রানি ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করেই বিস্তৃতি পেয়েছে। স্মার্ট ফোন এখন প্রায় সবার হাতেই। স্ক্রল করলেই নানা ধরনের ভিডিও দেখা যায়। কথা শোনা যাচ্ছে। ভালো-মন্দ জ্ঞান না করে একশ্রেণির নারী-পুরুষের উগ্র আচরণ এবং অপরশ্রেণির কটাক্ষ-বিদ্রূপ ও যৌন-হয়রানির মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিন্তু ইন্টারনেটে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়িয়ে চলতে কারও কোনো উদ্যোগ নেই।
লঘু হাস্যরসে ভরিয়ে তুলতে বা বিকৃত মানসিকতার চর্চা করতে গিয়ে কিছু মানুষ নারীদের শিকারে পরিণত করছে। আবার কিছু নারী নিজে থেকেই শিকারের সামগ্রী হয়ে উঠেছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যৌন-নিপীড়নের মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। কিছু বিকৃত রুচির মানুষ নারীদের পেজে বা নারীদের ওয়ালে গিয়ে বাজে মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ সেই মন্তব্যে আরও ঘি ঢালছে। এমনও দেখা যায় নারীদের অনলাইন ব্যবসা, নারীদের নানামাত্রিক রূপচর্চা-মেকাপ টিউটরিয়াল, জামা-কাপড়ের লাইভ, মোটিভেশান ভিডিও, টিকটকের নাচ-গান প্রভৃতিতে একশ্রেণির উগ্র রুচিসম্পন্ন পুরুষেরা বাজে মন্তব্য করছেন। আবার কেউ কেউ নারীর ছবি ব্যবহার করে বিভিন্নভাবে ট্রল করছেন, কেউবা মুখচ্ছবি ঠিক রেখে নানারকম বিভৎস ছবির সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন! এসব ঘটনা নতুন নয়।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রতিটি মানুষেরই কম বেশি জানা। নারীর ছবি ব্যবহার করে এসব বিকৃত রুচির প্রকাশ ঘটাচ্ছে। যার নাম রোস্টিং। কিন্তু অবাধে এ ধরনের ঘটনায় নারীরা বিভিন্নভাবে যৌন-হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
শুধু যে ইন্টারনেটেই এখন নারীকে বিনোদনের নামে যৌন-হয়রানি শিকার করে তোলা হচ্ছে এমন নয়; বরং সুস্থ বিনোদন আজকাল দেখাই মিলছে না। সিনেমা, নাটকগুলোতেও নারীকে পণ্যে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীনতার অভাবে সমাজে এগুলো ক্যান্সারের মতো বাসা বাঁধছে। এর ফলে মানুষের মধ্যে একধরনের বিকৃত মানসিকতার সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলস্বরূপ নারীরা যৌন-হয়রানির শিকার হচ্ছেন। টিকটক অ্যাপসের বৌদলতে এখন প্রায় সবাই সেলিব্রিটি হওয়ার বাসনা পোষণ করছে। ফলে সস্তা কনটেন্ট, নাচ-গান দিয়ে মানুষের বিনোদনের চেষ্টা চলছে। টিভি, সিরিয়াল, নাটকগুলো এমনভাবে নির্মিত হচ্ছে যেখানে নারী ট্রলের শিকার হচ্ছে। বাজে মন্তব্যের ভিড়ে নিজেদের টিআরপি বাড়াতেই ব্যস্ত তারা।
এখন তো বিশেষ করে ইন্টারনেটে নারীদের হয়রানির ঘটনা অহরহ। বিনোদনের নামে যৌন-হয়রানি কমাতে প্রথমেই সরাকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। নেট ব্যবহারের ওপর রেশ টানতে হবে। নজরদারি না বাড়ালে নারীরা যেমন রক্ষা পাবে না সেইসঙ্গে সমাজের অপসংস্কৃতির চর্চাও কমবে না। মানুষ ধীরে ধীরে আরও বিকৃত হয়ে উঠবে। কারণ কথায় আছে ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে’। ফলে সমাজকে দেশকে বাঁচাতে এখনই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। আইনের শাসন আনতে হবে। যথেচ্ছ স্বেচ্চাচারী মনোভাবকে দমন করতে হবে। নারীকেও যেমন সাবধান হতে হবে। পুরুষের ওপর বিশেষ নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। আইনি পদক্ষেপ না নিলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কিছুতেই যৌন- হয়রানি কমবে না।
এর বাইরে টিভি সিরিয়াল, নাটক, সিনেমার ক্ষেত্রে সস্তা কনটেন্ট ও রুচির কাহিনি বর্জন করতে হবে। নারী সম্মানের পাত্রী। তাকে শ্রদ্ধা করে সমাজের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারে আমাদের বিনোদন মাধ্যমগুলো। কিন্তু সামাজিক কার্যক্রমে অংশ না নিয়ে শুধু বিকৃত মানসিকতার চর্চা ঘটছে। ফলে সমাজ হয়ে উঠছে অস্থিতিশীল। বেড়ে চলছে গুম-খুন-হত্যা-ধর্ষণ-যৌন হয়রানি-নারী নিপীড়ন প্রভৃতি সামাজিক অবক্ষয়ের। একটি আর একটির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। ফলে মানুষ যেখান থেকে শিক্ষা লাভ করে সেই স্তরগুলো স্বাভাবিক দর্শন-রুচির হওয়া জরুরি। সমাজে ধর্ষণের মতো ঘটনা এই চর্চার মাধ্যমেই কিন্তু শেকড় গজিয়ে উঠছে। ফলে বিনোদনের নামে যৌন-হয়রানি বন্ধে এখনই রাষ্ট্রীয়ভাবে তৎপর ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজিক বিধিনিষেধ সৃষ্টি করতে হবে। নতুবা কালবৈশাখী ঝড় কিছুতেই থামবে না।