Skip to content

২২শে জানুয়ারী, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ | বুধবার | ৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রাক্তন

আজকের আবহাওয়াটা কেমন যেন গুমোট একটা ভাব। হয়তো মনেরও। সকাল থেকেই আকাশটা মেঘে ঢাকা। মনে হচ্ছে এই বুঝি ঝুম বৃষ্টি নামবে। ধুয়ে মুছে সাফ করে নিয়ে যাবে সব জঞ্জাল।

অনেকক্ষণ থেকে ফোনটা বাজছে। মিলির সেই দিকে খেয়াল নেই। বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে সে। প্রায় প্রতিটা দিনের শুরুটা এভাবেই সময় কেটে যায় মিলির।

একমাত্র মেয়ে তিনা ও আসিফকে নিয়ে ছোট্ট একটা সাজানো সংসার তার। তিনা এইবার ক্লাশ ফাইভে পড়ে। আসিফ প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় তিনাকে নিয়েই বের হয়। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে অফিসে যায় আসিফ। আর দুপুরে তিনার স্কুল ছুটি হলে মিলি গিয়ে নিয়ে আসে মেয়েকে।

আবারও ফোনটা বাজছে। একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে উঠে গিয়ে মোবাইল কলটা ধরলো মিলি। অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসছে।

মিলি: হ্যালো কে বলছেন?
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই।
মিলি আবারো বললো: কে বলছেন প্লিজ বলুন, নইলে আমি ফোন রেখে দিবো।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে মৃদু স্বরে কণ্ঠ ভেসে আসলো: “আমি!”
“আমি” শুনেই মিলির বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো! পৃথিবীতে যে একজন মানুষই এভাবে বলে!!!
সেই একজন মানুষ কি সে?
একজন মানুষ কি এতবছর একই রকম থাকতে পারে কখনো??
কিভাবে থাকে একই রকম???
নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে মিলি বললো: আমিটা কে সেটাই তো জানতে চাইছি আপনার কাছে।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কণ্ঠ ভেসে আসলো:
তোমার “আমি” কে ভুলে গেলে এতটা অবলীলায়!!!

মিলি কীভাবে বোঝাবে গত পনেরো বছর যাকে মনে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে, যাকে বারংবার নিজের থেকে ভুলতে চেয়েছে কিš‘ কোনভাবেই ভুলতে পারেনি সে।
দীর্ঘ পনেরোটি বছর কেটে গেছে কিš‘ মিলির আজো মনে হয় গতকালও কথা হয়েছে তাঁর সাথে।

মিলি: অবশেষে মনে পড়লো তাহলে?
ফারহান: মিলি নামক গাছের শিকড়টা কি এতটা সহজে উপড়ে ফেলা যায়! সে যে ডালপালা গজিয়ে মহীরুহ হয়ে বুকে সংসার পেতে বসেছে!!
মিলি: কেমন আছো ফারহান?
ফারহান: টাকা দিয়ে কেনা বেনসন লাইটের একটা সিগারেট; জ্বলন শেষ, দহনও শেষ, সুখও শেষ!!!
মিলি: কখনো কি মিস করো আমায়?
ফারহান: সত্যি বলতে কি বহুদিন বুনো বাতাসে তোমার উড়ে আসা চুল মুখে পড়েনি আমার, এটাই মিস করেছি চিরকাল!
মিলি: তোমার এখনো মনে পড়ে?
ফারহান: আর দশ টাকার বেলি ফুলের মালা তোমার খোঁপায়!
মিলি: সাথে তোমার দুষ্টুমি জড়ানো বেয়াড়াপনা!
ফারহান: সন্ধ্যামালতিতে তোমার কাঁধে মাথা রেখে থালার মতো রূপালী চাঁদ দেখা!
মিলি: শরতে নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে কাশফুলের মাঝে হেঁটে যাওয়া বুঝি কিছু নয়!
ফারহান: শহর জুড়ে বৃষ্টি নামে আমার জন্য তুই, হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে মন বাড়িয়ে ছুঁই!!!
মিলি: একুশটা ডায়াজিপাম গিলেও তোমাকে ছুঁতে না পারার কষ্ট!
ফারহান: বয়ে চলা জীবন নদী।
মিলি: জীবন মানে মাড় গেলে ভাত রাঁধার মাঝে রসটা ফেলে দিয়ে ভক্ষন করা।
ফারহান: বাদ দাও এসব অর্থহীন কথা। যেখানে জীবনের কোন অর্থই নেই আর!
মিলি: এই তো বেশ আছি।
ফারহান: জীবন তেজপাতা বানিয়ে ভালো থাকা। আর ভালো তো থাকবেই।
মিলি: হুম, বেশ ভালো আছি!
ফারহান: আগামী শনিবার ক্লান্ত বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরিতে আসছো তো?
মিলি না বলার আগেই কলটা কেটে গেল,,,
শনিবার সকাল। মিলি অন্য দিনের মতোই বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে। ফারহানের ফোনের শেষ কথাটা তার মনে থাকলেও সে ঠিক করে রেখেছে সে পাবলিক লাইব্রেরি যাবে না।

এত বছর পর ফারহানের সাথে দেখা করার কোন মানেই হয় না। তাছাড়া আসিফকে বলাও হয়নি যে সে বের হতে পারে।

দুপুরে তিনাকে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় সে অদ্ভুত কাজ করে ফেললো। সে নেিজর বাসায় না এসে মায়ের বাসা যাওয়ার জন্য সিএনজি নিয়ে নিল।

মিলির মা এই ভর দুপুরে মিলি ও তিনাকে দেখে ভীষণ অবাক হলো, সেইসাথে খুশিও হলো। এতদিন পর মেয়ে নাতনিকে নিয়ে বাসায় আসছে খুশি তো হবেই।

মিলি মাকে বললো, মা আমার শরীরটা ভালো লাগছে না তাই চলে আসলাম তোমার কাছে। মিলির মা আমেনা বেগম তাকে বললো, খুব ভালো করেছিস মা। আসিফকেও ফোন করে দে, অফিস থেকে যেন এখানে চলে আসে। মিলি উত্তরে কিছু বললো না তার মাকে।

একটুপরে মিলি মাকে বললো, খিদে লাগছে খেতে দাও তো আমাকে আর তিনাকে খাইয়ে দাও। তিনার খাওয়ার পর ঘুমাতে বলো।

মিলি মায়ের হাতের পাবদা মাছের তরকারি দিয়ে আরাম করে ভাত খেলো। তারপর মাকে বললো, মা তোমার একটা নীল শাড়ি আছে না, ওটা কি ইস্ত্রি করা আছে?

মিলির মা আমেনা বেগম উত্তরে বললো, হ্যাঁ আছে। কেন কী করবি?

মিলি উত্তরে বললো, গোসল করে পড়বো। আর আমি একটু বের হবো। আমেনা বেগম কোথায় যাবি জিঞ্জাসা করতেই মিলি রেগে গিয়ে বললো, সব কথা কী তোমাকে বলতে হবে।

আমেনা বেগম মিলির রাগ দেখে আর কথা বাড়ানোর সাহস হলো না।

গোসল সেরে মায়ের নীল শাড়িটা পরিপাটি করে পড়ে এবং হাল্কা সেজে মিলি বের হলো। বের হওয়ার আগে মাকে বলে গেলো আমি আসিফকে ফোন করে বলে দি”িছ আমি তোমার এখানে এসেছি। আর আমি ফেরার আগে যদি আসিফ এসে পড়ে তাহলে ওকে বলিও আমি একটু বান্ধবী পলির বাসায় গেছি।

বিকাল ঠিক সাড়ে চারটায় মিলি পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে এসে রিকশা থেকে নামলো। মায়ের বাসা হাতিরপুল থেকে রিকশা নিয়ে সে এসেছে।

ফারহান আগে থেকেই মিলির জন্য অপেক্ষা করছিল।

মিলিকে দেখে ফারহান স্মিত হাসলো আর মিলিকে বললো, আমি জানতাম তুমি আসবে!

মিলি কথার উত্তর না দিয়ে ফারহানকে বললো চলো হাঁটি। ফারহান মিলিকে বললো কোথায় যাবে? আমার যে নতুন গ্রšে’র মোড়ক উন্মোচন প্রোগ্রাম আছে এখন পাবলিক লাইব্রেরিতে!

মিলি হাঁটছে ফারহানও পিছু হাঁটা শুরু করলো। এই প্রথম মিলি প্রশ্ন করলো, আমাকে আসতে বলেছো কেন?

ফারহান মিলির চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, তোমাকে একবার দেখতে!

মিলি উত্তরে বললো, মিথ্যা বলো কেন? তোমার নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন প্রোগ্রামে দেখতে আসতে বলেছো বুঝেছি। হাঁটতে হাঁটতে তারা টিএসসির গেটে এসে পড়েছে।

ফারহানের ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। ফোন রেখেই ফারহান বললো, অনুষ্ঠান শুরু হবে আমাকে যেতে হবে! তুমি যাবে আমার সাথে?

মিলি উত্তরে বললো, না!!!

ফারহান উল্টোপথে পাবলিক লাইব্রেরির দিকে হাঁটা শুরু করলো। মিলি দাঁড়িয়ে রইলো টিএসসির গেটেই।

যতদূর পর্যন্ত ফারহানকে দেখা যায় এক পলকে অশ্রæ সজল চোকে তাকিয়ে রইলো মিলি। আর ভাবতে লাগলো একজন মানুষ চিরকাল এমনি থাকে বোধহয়!!

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ