Skip to content

৯ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বুধবার | ২৪শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাড়ছে নারী বাইকার

বাংলাদেশের শহরে প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে, যা নারী বাইকারদের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। যেখানে একসময় নারী বাইকারের সংখ্যা নগণ্য ছিল, সেখানে এখন শহরের রাস্তায় নারী বাইকারদের উপস্থিতি ক্রমাগত বাড়ছে। এই পরিবর্তন শুধুমাত্র নারীর চলাচলের স্বাধীনতার প্রতীক নয়, বরং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারীর ক্ষমতায়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

পরিসংখ্যানের আলোকে নারী বাইকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, ২০১৮ সালে যেখানে নিবন্ধিত নারী বাইকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩,০০০, ২০২৩ সালের মধ্যে এই সংখ্যা প্রায় ১০,০০০-এ উন্নীত হয়েছে। এর অর্থ হলো, মাত্র পাঁচ বছরে নারী বাইকারদের সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। এই প্রবণতা শুধুমাত্র ঢাকায় নয়, বরং অন্যান্য বড় শহর যেমন চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, এবং খুলনাতেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিআরটিএ-এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের মোট মোটরবাইক নিবন্ধনকৃত নারীদের সংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ১৫-২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এটি প্রমাণ করে যে নারীরা এখন বাইক চালানোকে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করছেন, যা এক দশক আগেও এভাবে লক্ষ্য কর যায়নি।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট

নারী বাইকারের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় ধরনের কারণ রয়েছে। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে নারী কর্মশক্তির অংশগ্রহণও বৃদ্ধি পেয়েছে। শহুরে জীবনে নারীরা এখন আর কেবলমাত্র গৃহস্থালির কাজে সীমাবদ্ধ নন; তাঁরা অফিস, ব্যবসা, এবং অন্যান্য বহিরাঙ্গন কাজে ব্যাপকভাবে জড়িত হচ্ছেন। এতে করে নারীদের যাতায়াতের জন্য ব্যক্তিগত যানবাহনের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে।

অন্যদিকে, গণপরিবহনে হয়রানি, সময়ের অপচয় এবং নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকে বাঁচতে অনেক নারী বাইককে তাঁদের প্রাথমিক যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। বাইক চালানো তাঁদের জন্য শুধু সময় বাঁচানোর উপায় নয়, বরং এটি তাঁদের চলাচলের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করছে। এছাড়াও, নতুন প্রজন্মের নারীদের মধ্যে বাইক চালানোর প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক মিডিয়া এবং বিভিন্ন নারী বাইকার গ্রুপের সক্রিয়তার কারণে। এ ধরনের গ্রুপওনোর মাধ্যমে তারা শুধু বাইক চালানোর কৌশলই শিখছেন না, বরং নিজেদের মধ্যে একটি সমর্থনমূলক নেটওয়ার্কও তৈরি করছেন।

চ্যালেঞ্জ ও সংকট

যদিও নারী বাইকারদের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে, তবে তাঁদের সামনে এখনও উল্লেখযোগ্য কিছু সালেঞ্জ রয়ে গেছে। সড়কে পুরুষ বাইকারদের তুলনায় নারী বাইকাররা অনেক সময় হয়রানি, নিরাপত্তার ঝুঁকি এবং অজ্ঞাত পরিচয়ের বাইকারদের অবমাননার শিকার হন।

প্রচলিত মানসিকতা অনেক সময় নারী বাইকারদের বাঁধাগ্রস্ত করে, কারণ সমাজের একটি বড় অংশ এখনও মনে করে যে বাইক চালানো কেবলমাত্র পুরুষের কাজ। এছাড়া, নারীদের বাইক চালানোর প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার অভাবও একটি বড় আলেজ। অনেক নারীই প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই বাইক চালানো শুরু করেন, যা তাদের এবং অন্যদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

অন্যদিকে, যান্ত্রিক দক্ষতার অভাবে অনেক নারী বাইকার বাইক সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যায় পড়েন, যা তাঁদের আত্মবিশ্বাস হ্রাস করতে পারে। তবে, কিছু নারী বাইকার ক্লাব এবং সংগঠন এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। তাঁরা বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ প্রদান, সড়ক নিরাপত্তা সচেতনতা বৃদ্ধি এবং যান্ত্রিক সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছেন।

উদ্যোগ ও প্রশিক্ষণ

নারী বাইকারদের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং সরকারও নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২১ সালে এক নারী বাইকার প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ৫০০ জন নারী অংশগ্রহণ করেছিলেন, যেখানে তারা বাইক চালানোর মৌলিক কৌশন থেকে শুরু করে সড়ক নিরাপত্তা পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। এছাড়, সরকারের উদ্যোগে নারী বাইকারদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং সহজ কিস্তিতে বাইক ক্রয়ের সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।

এছাড়াও, কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন গ্রামীণফোন, রবি, এবং বিকাশ তাদের নারী কর্মীদের বাইক চালানোর প্রশিক্ষণ প্রদান করছে এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। এর ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি তাঁদের স্বাধীনতা এবং আত্মবিশ্বাসও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি

বাংলাদেশে নারী বাইকারদের সংখ্যা বৃদ্ধির এই প্রবণতা

কেবলমাত্র একটি সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং এটি নারীর ক্ষমতায়নের একটি নতুন অধ্যায় উন্মোচন করছে। একসময় যেখানে নারীরা বাইক চালানোকে কেবলমাত্র পুরুষদের কাজ হিসেবে দেখতেন, সেখানে এখন এটি তাঁদের জন্য একটি ক্ষমতায়নের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নারীদের জন্য নিরাপদ সড়ক এবং আরও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করা সম্ভব। সরকারের পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের মানুষের সমর্থনই পারে নারী বাইকারদের সংখ্যা আরও বাড়াতে এবং তাঁদের চলার পথকে সুগম করতে।

এই পরিবর্তন কেবল নারীদের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্যই একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদার মনোভাবের প্রতিফলন। আগামী দিনে আরও বেশি নারী বাইকারের উপস্থিতি আমাদের শহরের রাস্তায় দেখতে পাওয়া যাবে, যা একটি উন্নত, স্বাধীন, এবং আধুনিক সমাজ গঠনের পথকে আরও সুদৃঢ় করবে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ