নবনীতা
গভীর রাত্রি, বাহিরে জ্যোৎস্নায় ফিনিক ফুটিতেছে। এই নিশুতি রাতে স্বপ্নময় দিনের আবেষ্টনী হইয়া দুগ্ধফেননিভ শয্যায় ঘুমহীন চোখের কোণে জল গড়াইয়া পড়িতেছে।
নিস্তব্ধতা চাপা উত্তেজনা গ্রাস করিয়া দাঙ্গা করিতেছে। একা একা ঘরে শুইয়া আছি, চুরি করিয়া এক ফালি জ্যোৎস্না জানালা দিয়া প্রবেশ করিয়াছে। প্রবেশ করিয়া তন্দ্রাগোরে থমকিয়া দাঁড়াইয়া আছে। মাথার ভিতরে গোল পৃথিবীর মতো ঘুরিতেছে প্রথম প্রেমিকার মুখ। এই ব্যথাতুর মনে জ্যোৎস্না পুলকিত যামিনীর আলোয় ঘেঁষে একবার প্রেম আসিয়াছিল। তখন আমার বয়স কাঁচা। সবে মাত্র স্কুল ডিঙ্গাইয়াছি।
কলেজের প্রথম দিন হইতেই নবনীর প্রতি আলাদা একটা নজর পড়িয়াছিল। একবার চোখাচোখি হইয়াছিল। ভীরু মন ভয়কাতর হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছিল। আজ সাত বছর পরে নিষুপ্ত রাতের অন্ধকারে আঁখির পাতায় জ্যোৎস্নার আবেশে সেই রূপালী আলোর মুখ নবনীর কথা মনে পড়িতেছে। নির্জন শয্যায় তাহার স্মরণে ব্যথাতুর মনে অশ্রু- তর্পণ। এই গোপন হৃদয়ে ভীরু বার্তাটি ছিল, পছন্দের মানুষটার সম্মুখে দাঁড়াইয়া ভালোবাসার কথাটা কখনও বলিতে পারি নাই।
কাঁচা বয়সে মনে মনে তাহার প্রতি যে আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা জাগিয়া উঠিয়াছিল, তাহা গোপনেই ধীরে ধীরে চুপিচুপি কালের অমোঘ নিয়মানুসারে আপনা আপনিই নিভিয়া গিয়াছে। শুধু যাহা থাকিয়া গিয়াছে তাহা তাহার প্রতি আসক্তির মোম। হঠাৎ করিয়া রাত্রির নিস্তব্ধতায় ঘুম ভাঙ্গিয়া গেলেই তাহার কথা উদয় হয়, তখন মনের ভিতর দাঙ্গা- হাঙ্গামা করিয়া ওঠে। জীবনের প্রথম প্রেম। তাহাও ছিল একতরফা ভালোবাসা। পরে তাহার সহিত কথাবার্তায় যতটুকু বুঝিয়াছি-নবনীও আমাকে গোপনেই ভালোবাসিয়াছিল। তাহার চোখের কোণে তা ফুটিয়া উঠিয়াছে।
নবনীর রূপে একটা মোহ ছিল, নবনীকে যেদিন প্রথম দেখিয়াছিলাম তখনই তাহার রূপের মোহে আটকাইয়া গিয়াছিলাম। নবনীর রূপের মোহে যে শুধু পুরুষই মুগ্ধ হইবে তাহা নহে, অবলা নারী থেকে শুরু করিয়া যে দেখিবে সে’ই তাহার আচার-আচরণে মুগ্ধতায় ডুবিয়া যাইবে। নরম হইয়া পড়িবে অনেকটা। নবনীকে অনেকবার ভালোবাসার কথা বলিবার জন্য চেষ্টা করিয়াছি। ভীরুতার কারণে আতিথেয়তার প্রণয় দীর্ঘায়িত হয়নি। তাহা একতরফা হইয়া মনে মনেই থাকিয়া গেল। মুখ ফুটিয়া বলা হইয়া ওঠে নাই যে, নবনী তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি।
আজ তন্দ্রাঘোরে নিদ্রাহীন নয়নপল্লবে যে অশ্রুসঞ্চার তাহা একটা আঁধার ঢাকা ব্যথাতুর রাতের। এই রাত যেন ডাইনির মতো আমাকে শিস দিয়া ডাকে। স্তব্ধ হইয়া আছে গাছপালা কংক্রিটের সীমানা প্রাচীর। সব যেন দাঁড়াইয়া ঝিমাইতেছে। গগনের নক্ষত্রগুলোকে দেখিয়া মনে হইতেছে, তাহারাও আমার মতোই হতভাগা। এই ব্যথাতুর মন জানালার পাশে শুইয়া রিক্ত তৈল মৃৎ প্রদীপের মতো পুড়িতেছে। জীবনের আয়ুষ্কাল ফুরাইয়া যাইতেছে, এখন শুধু জীবন প্রদীপের সলতেতে আগুন ধরা বাকি রহিয়াছে। নবনীর মোহে ঐটুকু ছাই হইতে বেশি দেরি হইবে না।