মীর মশাররফ হোসেনের জয়নব
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২) একজন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী শিল্পী। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তিনি সাহিত্য জগতে পদার্পণ করেন। বাংলা সাহিত্যে তখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনার গৌরবে ভাস্বর। তখনো বাংলা ভাষা চর্চায় তেমন কোনো মুসলমান সাহিত্যিক এগিয়ে আসেননি। তিনিই প্রথম মুসলমান গদ্যশিল্পী। তার বিষাদসিন্ধু বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী গ্রন্থ। কারবালার বিষাদময় ঘটনাকে অবলম্বন করে লেখক গড়ে তুলেছেন এক অনবদ্য সাহিত্যকর্ম। এই গ্রন্থটির জন্যই বিশেষভাবে তিনি বাঙালি পাঠক সমাজে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। গ্রন্থটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। ‘বিষাদসিন্ধু’র মহররম পর্ব ১৮৮৫, উদ্ধার পর্ব ১৮৮৭ ও এজিদ বধপর্ব ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
বিষাদসিন্ধু গ্রন্থের রূপায়ণে লেখক ইতিহাস ও কল্পনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তাই মহরম পর্বে ইতিহাসের সাক্ষাৎ ঘটলেও উদ্ধার পর্ব এবং এজিদ বধপর্ব অনেকাংশে কল্পনাশ্রিত। এই গ্রন্থে একাধিক চরিত্রের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। লেখক মুসলিম ঐতিহ্যের নবতর রূপায়ণ করেছেন। এখানে স্থান পেয়েছে অসংখ্য চরিত্র। যাদের মধ্যে দিয়ে লেখক জীবনের অনুসন্ধান করেছেন। হিংসা, লোভ, কপটতা, নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত রূপ তুলে ধরা হয়েছে। আর উঠে এসেছে রূপমুগ্ধ মানুষের অন্ধ আস্ফালন।
একদিকে পূত-পবিত্র জীবনের প্রতীক মোহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হাসান, হোসেন ও অন্যদিকে মাবিয়া পুত্র উদ্ধত-নিষ্ঠুর এজিদ। এজিদ কামলোলুপ, মদ্যপ। জনৈক আবদুল জব্বারের স্ত্রী সুন্দরী, অপ্সরী জয়নব। জয়নবের ওপর এজিদের কুদৃষ্টি পড়ে। নানারকম ছলনার আশ্রয় নেয় এজিদ। একসময় লোভের ফাঁদে পড়ে আবদুল জব্বার তার স্ত্রী জয়নাবকে ত্যাগ করে। জয়নাব স্বামীর থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে মনে আঘাত পায়। সে এজিদের চক্রান্ত বুঝতে পারে। তাই এজিদের বিবাহের পয়গাম গ্রহণ না করে হজরত ইমাম হাসানকে পতিরূপে বরণ করেন।
এজিদ প্রতিহিংসায় জ্বলে ওঠে। ঘটনার গতি-প্রকৃতি এখান থেকেই শাখা-প্রশাখায় ছড়াতে থাকে। মায়মুনা নামের এক কুচক্রী, ষড়যন্ত্রকারী এজিদের পরামর্শে জায়েদাকে প্ররোচিত করে।একসময় জায়েদা তার স্বামী হাসানকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করে এবং কারবালার প্রান্তরে সীমার ইমাম হোসেনকে এক নিদারুণ, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। কারবালার নৃশংস কাহিনি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডকে আশ্রয় করে লেখক বিষাদ-সিন্ধু রচনা করেন। যা বাঙালি পাঠক মনকে যুগযুগ ধরে ক্ষতবিক্ষত করে আসছে।
বিষাদসিন্ধুর কাহিনি অত্যন্ত করুণ। দাম্ভিক এজিদের হাতে ইমাম পরিবারের শাহাদত বরণই এই গ্রন্থের বিষয়। তবে জয়নব চরিত্রটি এই বিষাদময় কাহিনির নেপথ্যে সক্রিয়। স্বামী আবদুল জব্বারের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে ইমাম হাসনকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছে। এখানে দুটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
প্রথমত, এজিদ লম্পট, কামলোলুপ, মদ্যপ তবে সে জয়নাবের রূপে মুগ্ধ হয়েছে। কিন্তু প্রেম দিয়ে নয় বরং ষড়যন্ত্র করে জয়নবকে আপন করে পেতে চেয়েছে। ফলে তার জন্য জয়নাবের মনে শুধু ঘৃণা ও ভয়সৃষ্টি হয়েছে। বিবাহের পয়গাম প্রত্যাখ্যান করেছে।
বাংলা সাহিত্যে মীর মশাররফ হোসেন অমর হয়ে আছেন তার গৌরবময় রচনা বিষাদসিন্ধুকে কেন্দ্র করে। পাঠকচিত্তের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে পেরেছে বলেই আজও বিষাদসিন্ধু সবার কাছে সমানভাবে গ্রহণীয়।
দ্বিতীয়ত, এজিদ অবিবাহিত পুরুষ হলেও জয়নাব তাকে গ্রহণ করেনি। কিন্তু ইমাম হাসানের স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাকে পতি হিসেবে পেতে চেয়েছে। এখানে জয়নাবের দিক থেকে ভরসা, আশ্রয়স্থল, জীবনে একজন ভালো সঙ্গী কামনা, এমনকি এজিদের হাত থেকে কেউ রক্ষা করতে পারে সেও ইমাম হাসান। ফলে সবদিক বিবেচনা করে জয়নাবের স্বার্থান্বেষী ভাবনা তাকে এদিকে ধাবিত করেছে। আর এজিদের জন্যই যখন জয়নাবের পূর্বের সংসার ধ্বংস হয়েছে ফলে নিশ্চিতভাবেই তার প্রতি মনে মনে ক্রোধ, ঘৃণা থাকা অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু জয়নাবের পতিরূপে গ্রহণ করাটায় ইমাম হাসান, হোসেনের জন্য জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ালো। তবে এটা অনেকটা শেক্সপিয়ারিয়ান ট্র্যাজেডির মতোই নিয়তি নির্ধারিত। পূর্বে থেকেই সব নির্ধারণ ছিল। এজিদ, জয়নাব, জায়েদা, ইমাম হাসান, হোসেন সবাই সুতোয় বাঁধা। নিজেদের অদম্য চেষ্টাও এ ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হওয়া থেকে বাঁচাতে পারতো না। তবে বিষাদসিন্ধু গ্রন্থটিতে মীর মশাররফ হোসেন ইতিহাসকে সাক্ষী মেনেই গ্রন্থটি রচনা করেছেন। রামায়ণের মতো কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাননি। এখানে সবাই রক্তমাংসের মানুষ হলেও দ্বৈবমতেই তাদের জীবনবসান। তবে রামায়ণে মাইকেল রামকে নয় বরং রাবণকেই নায়কোচিত রূপ দিলেন। বৈপ্লবিক বিপ্লব ঘটালেন সমাজমানসে। এ গ্রন্থে রাবণের মতোই শক্তিশালী এজিদ। কিন্তু রাবণের জন্য মানুষের মনে করুণা জন্মে, যেটা এজিদের জন্য কখনোই জন্মে না! গ্রন্থটির সমালোচনায় মধুসূদন দত্তের সঙ্গে মীর মশাররফ হোসেনের তুলনা করেছেন বঙ্কিম। তিনি বলেছেন, ‘এই গ্রন্থের চরিত্র সৃষ্টির সাথে মেঘনাদবধ কাব্যের চরিত্রসৃষ্টির সাদৃশ্য আছে। মেঘনাদবধের নায়ক রাবণের যেমন অসীম ক্ষমতা, তেমনি তার দুঃখ। এজিদ রাবণের মতো শক্তিশালী। মেঘনাদবধের সীতা হচ্ছে বিষাদসিন্ধুর জয়নাব৷ জয়নাবের স্বগোতক্তি সীতা-সরমার কথা স্মরণ করে দেয়।’
জয়নাব চরিত্রের সঙ্গে সীতা, সরমা চরিত্রের কিঞ্চিৎ হাহাকারের রূপ মেলে। তবে সীতা প্রথম থেকেই পতিপরায়ণ। পরবর্তীকালে লোক সমাজের ভয়ে তাকে বিসর্জন। আর বিষাদসিন্ধুতে জয়নাব আবদুল জব্বারের পত্নী থেকে প্রত্যাখ্যাত। পরবর্তীকালে ইমাম হাসানকে পতিত্বে বরণ। এই বরণের মধ্যে জয়নাব নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছে। কিন্তু এজিদের আক্রোশ ভয়ংকররূপে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। দৈব্যের হাতেই যেন এ উপন্যাসের পাত্র-পাত্রী ধাবিত হয়েছে৷ যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে। লেখক নিজ কল্পনায় রাঙালেও মূল ঘটনা থেকে তিনি সরে যাননি। বরং মূল ঘটনাকে কল্পনা দিয়ে আরও বেশি হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছেন। যার ফলে বাঙালি মুসলমান সমাজের মনেও ভরাডুবি বিষাদের ছায়া দেখা যায়।
জয়নাব চরিত্রটির ইমাম হাসানকে স্বামীত্বে বরণ মহভারতের রুক্মিণী চরিত্রটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের কন্যা রুক্মিণীর সঙ্গে চেদিরাজ দমঘোষের পুত্র শিশুপালের বিবাহ ঠিক হয়, তখন রুক্মিণী শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে গ্রহণ করে। রুক্মিণীকে কেন্দ্র করে শিশুপাল ও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। একসময় শ্রীকৃষ্ণের হাতে শিশুপালের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসে ইমাম হাসানই পরাজয় বরণ করে। স্ত্রী জায়েদা কর্তৃক বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়। যদিও এটি সাহিত্য কিন্তু এর উপাদান মুসলিম ইতিহাস থেকে নেওয়া। ফলে মীর মশাররফ হোসেন ইতিহাসের বর্ণনায় স্থির থেকেছেন।
ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, এজিদের সঙ্গে হাসান, হোসেনের বিরোধের কারণ রাজনৈতিক, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল নিয়ে। কিন্তু বিষাদসিন্ধু গ্রন্থের মীর মশাররফ হোসেন দেখিয়েছেন কারবালার জেহাদের পশ্চাতে মূল উৎস প্রেম। জয়নাবের রূপ লালসায় এজিদ হাসানের বংশ ধ্বংস করতে উদ্যত হয়। শুধু প্রেমের জন্যই এতবড় বিধ্বংসী কর্মযজ্ঞ চলেছে এরূপ চিত্রই ফুটে উঠেছে। সমালোচক আবদুল হাইয়ের ভাষায়, ‘কারবালার প্রান্তরে যে অগ্নিগর্ভ সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় এবং যার ফলে অগণিত বীরের রক্তস্রোত বয়ে যায় তারও স্ফুলিঙ্গ যুগিয়েছে জয়নাবের রূপবহ্নি। নিজস্ব জীবনবোধ, আবেগ প্রবণতা এবং রসযুক্ত মানবিক কাহিনি সৃষ্টির প্রবল কামনা মীর সাহেবকে ইতিহাসের তথ্য থেকে বার বার দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে।’
জয়নাব, জায়েদা,ইমাম হাসান, ইমাম হোসেন, এজিদ চরিত্রগুলোর পূর্ণ বিকাশের জন্য অনেকসময় কল্পনাকে আরোপ করেছেন। আর জয়নাবের রূপ সৌন্দর্য্যই একটি গোষ্ঠীর ধ্বংসলীলাকে উস্কে দিয়েছে। কারবালার যুদ্ধ এখানে এসে মহাভারতের সঙ্গে একটি বিশেষ অংশে যুক্ত হয়েছে আবারও। কৌরব কর্তৃক দ্রৌপদীর অপমান, অসম্মান যেমন পঞ্চপাণ্ডবকে যুদ্ধে সক্রিয় করে ঠিক যেন জয়নাবকে পাওয়ার বাসনা এজিদকে আক্রমণাত্মক করে তুলেছে। কারবালার যুদ্ধে এজিদকেই পরিপূর্ণরূপে ভয়ংকর এবং বিনাশী হতে দেখা যায়, কিন্তু ইমাম হাসান বা হোসেনকে বিনাশী ভূমিকায় দেখা যায় না।
বাংলা সাহিত্যে মীর মশাররফ হোসেন অমর হয়ে আছেন তার গৌরবময় রচনা বিষাদসিন্ধুকে কেন্দ্র করে। পাঠকচিত্তের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে পেরেছে বলেই আজও বিষাদসিন্ধু সবার কাছে সমানভাবে গ্রহণীয়। এর স্বচ্ছ সাবলীল রচনারূপ যুগ যুগ ধরে প্রবহমান থাকবে বাঙালির মনে।