বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার জর্জিনা হক
৪৪ বছর পর ২০১৬-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের হাতে সম্মাননা স্মারক পান জর্জিনা হক।
১৬ বছর বয়সেই ‘স্পন্দন’ এর সাথে ড্রামস বাজিয়েছিলেন জর্জিনা হক। ‘স্পন্দন’ হলো বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল এর পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত একটি ব্যান্ড। ১৯৭২ সালে প্রথম বিজয় জয়ন্তী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির এক অনুষ্ঠানে তিনি এই ড্রামস বাজিয়েছিলেন। এটিই ছিল তার প্রথম নারী ড্রামার হিসেবে আত্মপ্রকাশ।
তিনি নিজেই জানান, ১২ বছর বয়সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন যে, তাকে ড্রামসই বাজাতে হবে। তিনি বলেন,“বার বছর বয়সে আমি রান্না ঘরের বাসনপত্রে ড্রামস অনুশীলন করতাম।”
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ একজন এবং সেসময়কার প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ফরমাজুল হকের কন্যা জর্জিনা হক, তার জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ।জর্জিনা হকের দশ ভাই বোনের সকলেরই ছিল গান-বাজনার প্রতি কমবেশি আগ্রহ , আর সেই সুবাদে জর্জিনাও সুরকে ভালোবাসতেন। তবে তিনি সুরকে ভালোবেসেছিলেন অন্যরকমভাবে, সুরকে গলায় না ফুটিয়ে বরং তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন বাদ্যযন্ত্রে। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে ভাইয়ের ড্রামস বাজাতেন তিনি।
ড্রামস এর প্রতি তার এতটা-ই ভালোবাসা ছিলো যে তিনি ইটভাঙা নারী শ্রমিকদের সঙ্গে বসে ইট ভাঙার তালের সঙ্গে বাজানোর অনুশীলন করতেন। এমনভাবে অনুশীলন করতে দেখে এবং তার এমন আগ্রহ দেখেই শেখ কামাল তাকে স্পন্দন ব্যান্ডের সঙ্গে অনুশীলন করতে বলেন। এভাবেই স্পন্দনের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি এবং শেখ কামালেরই উৎসাহে ১৯৭২ সালে টিএসসিতে ড্রামস বাজিয়ে ছিলেন তিনি। এরপরেই দেশের প্রথম নারী ড্রামার হিসেবে খ্যাত পান তিনি।
তিনি জানান যে, উইন্ডি সাইড অব কেয়ার (সাবেক আয়োলেটস) ব্যান্ডের ড্রামার সাব্বির কাদেরের বাজানো দেখে ড্রামস বাজাতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন প্রথম। এটি তাকে এতটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যে সেই ছোট থেকেই ড্রামস বাজাতেন যেকোন কিছু দিয়েই।
দেশের প্রথম নারী ড্রামার নাম হবার পর সেভাবে জনসম্মুখে বাজানো না হলেও তারা তিন বোন মিলে গঠন করেছিলেন ব্যান্ড ‘থ্রি হাকস সিস্টারস’। সে সময়ে বেশ কিছু ছোটখাটো অনুষ্ঠানে বাজিয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যে বেইলি রোডের মহিলা একাডেমি, হলি ক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রেসকোর্স ময়দানে ছিল কয়েকটি অনুষ্ঠান। এরপর, বিয়ের পর স্বামী-সন্তানসহ বহু বছর ছিলেন বিদেশে। তবে বিয়ের পরও তিনি ড্রামস বাজানো ছাড়েননি। সেভাবে কোনো ব্যান্ডের সাথে যুক্ত না থাকলেও তিনি নিজেই চর্চা চালিয়ে গেছেন বরাবরই। প্রবাসে থাকাকালে বিশেষ অনুরোধে দু-একটা অনুষ্ঠানে বাজিয়েছিলেন তিনি জানান। বিয়ের পরের গল্প মনে করে মজার একটি স্মৃতি শোনান তিনি। তাকে বিয়ের পরের দিন শ্বাশুড়ী জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি কী পারো?” তিনি বুঝতে না পেরে শ্বাশুড়ী কী জানতে চাইছেন এবং তিনি সরল ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছিলেন যে , “আমি ড্রামস বাজাতে পারি।”
এরপর ৪৪ বছর পর টিএসসিতে ফিরে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার। ২০১৬ সালের ‘রক্তে রাঙা বিজয় আমার’ অনুষ্ঠানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি কেন্দ্রিক সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিজয় দিবস উপলক্ষে একত্রে প্রতিবছর ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আয়োজন করে এ অনুষ্ঠান। টিএসসির সামনে, পায়রা চত্বরে ‘ওপেন এয়ার ‘ কনসার্টে বিজয় দিবস উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানে ব্যান্ড ল্যাম্পোস্ট-এর সাথে এসেছিলেন তিনি, ৪৪ বছর পর ফিরে এসে গিটার বাজিয়ে, গান গেয়ে আর ড্রামস বাজিয়ে দর্শকদের পুরো মাতিয়ে রাখেন তিনি সেদিন। মঞ্চে উঠে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। ৪৪ বছর আগে টিএসসি-তে বাজানোর সে অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা আবেগভরা কন্ঠে সকলকে শোনান তিনি। সেদিন জর্জিনা হকের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। এরপর তার পরিবেশনা চলাকালিনই শুরু হয়ে যায় ১৬ ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর এবং চলতে থাকে বিজয় দিবসের আতোশবাজী।
বাংলাদেশে ষাট-সত্তরের দশকে বাদ্যযন্ত্র বিশেষ করে পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র বাজানো ছেলেদের কাজ- এমন একটা ধারণা ছিলো মানুষের মাঝে। নারীদের পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র বাজানো খুব একটা ভালো চোখে দেখা হতো না। এমনকি এখনো নারীদের ড্রামস বাজাতে দেখা যায় হাতে গোনা কয়েকজনকে। মেয়েদের জন্য ড্রামস বাজানো কষ্টের বা ড্রামস মেয়েদের জন্য উপযুক্ত বাদ্যযন্ত্র নয় এমন মানসিক প্রতিবন্ধকতা হয়তো অনেক নারীই অতিক্রম করতে পারেনি। এছাড়া সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির মত বড় বাধা তো রয়েছেই। কিন্তু তবুও সেসময় এত বাধা অতিক্রম করে এমন বৈরি পরিবেশেও জর্জিনা হক তার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছিলেন। এবং এর পিছে একমাত্র কারণ তার প্রবল আগ্রহ ও মনোবল। এ প্রসঙ্গে তিনি সেসময়কার তার অভিজ্ঞতার কথা জানান যে। অনেকেই নানা ধরনের কথা শোনাতো তার ড্রামস বাজানোকে নিয়ে। এর মধ্যে যে শুধু পুরুষরা ছিল তা-ই নয়, ছিল অনেক নারীরাও। পরবর্তীতে তিনি যখন ব্যান্ডের সাথে বাজানো শুরু করলেন তখন অনেকেরই দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে শুরু করছিলো।
সম্প্রতি মালিবাগের একটি ক্যাফেতে অনুরোধে ড্রামস বাজানোর সময় তিনি বলেন যে, সাধনা ও শিক্ষার জোরে মেয়েরা সকল বাধা অতিক্রম করতে পারে বলে তিনি মনে করেন। এবং মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলেন যে, “তোমাকে দেখতে কেমন লাগছে, তার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে বরং গুরুত্ব দেয়া উচিৎ গানের চর্চার প্রতি।”