নারীর বেশি বয়সে বিয়ে সমাজের আপত্তি কেন
সমাজ নামক ঘোরটোপ থেকে যেন জাতির মুক্তি মিলছেই না। নারীর জীবনযাপনে বিধিনিষেধের শেষ নেই। সেইসঙ্গে চলে নারীর ওপর দমন-পীড়ন। সমাজের এক অতি সামান্য ও তুচ্ছ হিসেবে নারীকে গণ্য করা হয়। তাই নারীর কোনো কাজই যেন সমাজের মনঃপুত হয় না। যখন শুধু ঘরের কাজে সময় পার করে নারী, তখন কিছু লোকের বুলি হয়, সারাদিন তো ঘরেই থাকো। কাজের বেলায় খুঁজে পাওয়া দায়। আবার যখন নারী বাইরে উপার্জন করে, তখনো নারীকে নানারকম মন্তব্যের শিকার হতে হয়। এখন আবার নতুন ট্রেন্ড চালু হয়েছে সমাজে। নারীরা কেন বেশি বয়সে সেটেল্ড হলে বিয়ে করছে, তা নিয়েও কটুকথার শেষ নেই।
নারীদের পরম আশ্রয়স্থল বাবার বাড়িই মনে করা হয়। কিন্তু সেখানেও নারীদের নিশ্চিন্ত জীবনযাপনে কি বাধা দেওয়া হয় না? আমাদের চারপাশের ঘটনাগুলোই তার প্রমাণ দেয়। নানামাত্রিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সমাজের স্রোত কিছুটা উল্টোমুখী। তবে তা অবশ্যই ইতিবাচক পরিবর্তন। এখনকার নারীরা নিজের ক্যারিয়ারের ওপর ফোকাসড বেশি। যেটি আগেরদিনে ছিল না বললেই চলে। একটা বয়সের পর বাবা-মা সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে বিয়ে দিয়ে দিতো। তাদের মানসিক প্রশান্তি ছিল তার মধ্যেই। কারণ তাদের কাছে প্রধান চাহিদা একজন সুপাত্র। আর তার কাছেই মেয়েটা আজীবন সুখে থাকবে এমন বাসনা ছিল পরিবারের। এই ধারণার হয়তো সিকিভাগ পরিবর্তন এসেছে।
নারীরা অনেকটা সচেতন। কিন্তু পরিবারগুলো সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। কারণ তাদের মানসিকতায় বদ্ধমূল ধারণাটা আঁঠার মতো লেপ্টে আছে। বিয়েই মেয়ের জীবনে সুখ বৃদ্ধি করতে পারে। তাদের এই মানসিকতার পেছনে সমাজ বড় ভূমিকা পালন করে। সমাজের চোখে এখনো নারীর জন্য সংসারটাকেই প্রধান মনে করা হয়। কিন্তু একজন পুরুষের যেমন নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি ঠিক নারীর পক্ষেও কি তা নয়? পুরুষটির বাবা-মা-বউকে দেখতে হবে বিধায় তাকে স্বাবলম্বী হতে হবে৷ তবে নারীটির কি কেউ থাকতে নেই? সর্বোপরি নিজের জন্যও কি নারীর স্বাবলম্বী হওয়া উচিত নয়?
নারীর আবার পড়াশোনাই বা কী? আর ক্যারিয়ার ওর আবার কী দরকার! সুন্দর মতো স্বামী উপার্জন করবে আর নারী বসে বসে খাবে।
এখনো আমাদের সমাজে অহরহ ঘটে চলেছে বাল্যবিবাহ। সরকার আইন করে, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে অনেকটা কমিয়ে আনতে চেষ্টা করলেও তা শতভাগ হয়নি। বরং বহু বাল্যবিবাহ গ্রামাঞ্চলে ঘটছে। কিন্তু এর দায় কার? নিশ্চয়ই প্রথম দায় পরিবারের। দ্বিতীয়ত সমাজের। তৃতীয়ত নারীরা নিজেরাই দায়ী।
পরিবারগুলো যতদিন বিশ্বাস ও পালন করতে শিখবে না যে, নারীরাও মানুষ, তাদেরও নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার দরকার, ততদিন নারীকে এই মানসিকতার বলি হতে হবে। আর পরিবারের চেয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যা এবং সংকীর্ণ মানসিকতা ধারণ করি সমাজে বসবাসকারী লোকজন। অন্যের ঘরে ঢুঁ মেরেই যেন কিছু ব্যক্তির শান্তি জোটে। তাই বাবা-মাও অনেকক্ষেত্রে অর্থনৈতিক চাপ, সমাজের চাপে পড়ে কন্যাকে পাত্রস্থ করছেন।
সচেতনতার দায় যে একেবারেই বর্তমান নারীরা ভোগ করছেন না, এমন নয়। বরং এখনকার অনেক নারীকে শুনতে হয় আর কবে বিয়ে করবে? বয়স তো ত্রিশ ছুঁলো প্রায়? আর কতদিন এমন বাউণ্ডুলে জীবন? কিন্তু কোনো বাবা-মা বা সমাজের মানুষের মুখে পুরুষের জন্য এই আস্তাকুঁড়ে বাণী শুনিয়েছেন কি না, সন্দেহ? বরং পুরুষ হলে আরও তাকে বড়দের উপদেশ দিতেই শোনা যায়, আগে চাকরি; তারপর সবকিছু গুছিয়ে বিয়ের নাম আনবে। তাছাড়া কিন্তু জটিলতা বাড়বে। আর নারীর বেলায় বালাইষাট। নারীর আবার পড়াশোনাই বা কী? আর ক্যারিয়ার ওর আবার কী দরকার! সুন্দর মতো স্বামী উপার্জন করবে আর নারী বসে বসে খাবে।
তবে সমাজের এই কানকথা গায়ে মাখলে নারীদের আসলেও কোনোদিন উন্নতি সম্ভব নয়। কারণ নারীর সবদিকেই পায়ে শেকল পরানো। তাই আগে নিজের সম্পর্কে সচেতন হন। জীবনকে নিরাপদ করে তোলাই হোক নারীর ব্রত।
এই ধারণার বলি হওয়া নারীরাই জানেন তাদের অন্তরের কী জ্বালা! উঠতে বসতে বর বা বরের পরিবারের কাছে খোঁচা খেতে হয়। তোমার বান্ধবী তো না কি কোথায় চাকরি করে। তুমি তো একই সঙ্গে পড়লে৷ এত পোড়াশোনা দিয়ে কী করলে? এখন আর সমাজ এসে এই নারীকে বাঁচায় না। বরং সমাজে এখন তাদের সঙ্গে হাতে তালি দিয়েই উপভোগ্য এবং রোমাঞ্চকর করে তোলে পরিবেশ। কিন্তু বেশি বয়সে বিয়ে একদম নয়। কারণ কী? বাচ্চা হবে না। ভালো পাত্র জুটবে না। বুড়ি হবে। আর কতরকম কথা। প্রযোজ্য কিন্তু সব নারীর জন্যই।
নারীর বেশি বয়সে বিয়ে নিয়ে যাদের সমস্যা, তারাই আবার বিয়ের পর খোঁচায় রক্তাক্ত করে তোলে বাচ্চাটা আর কতদিন পর নেবে? এরপর নিলে তো আর হতেই চাইবে না। এবার তো এদিকে নজর দাও। তাহলে একজন নারী তো আর দশভূজা নন সত্যিই! তিনি সব করে আপনাদের সমাজ নামক বস্তাপচা সংস্কারের সঙ্গে শুধু ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ’ করে যাবেন।
নারীদের কিছুটা মানসিকতার পরিবর্তন এবং নিজের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি হওয়ায় নারীরা নিজ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে চান। কিন্তু সেখানেও একদল দানব এসে হানা দেয়। লণ্ডভণ্ড করে দেয় চারপাশ। তবে সমাজের এই কানকথা গায়ে মাখলে নারীদের আসলেও কোনোদিন উন্নতি সম্ভব নয়। কারণ নারীর সবদিকেই পায়ে শেকল পরানো। তাই আগে নিজের সম্পর্কে সচেতন হন। জীবনকে নিরাপদ করে তোলাই হোক নারীর ব্রত।