শীতের একাল-সেকাল
ভোরে হালকা কুয়াশার সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস। রাত যত গভীর হয় শীতের ভাবটা আরও গাঢ় হয়। এভাবেই আসতে থাকে শীতের বার্তা। অপেক্ষা করা হয়। শীতের একাল-সেকালে এই বিষয়টির পরিবর্তন হয়নি। দিনের আয়তন সংকুচিত হয়ে যেতে শুরু করে। কদিন আগেও যেখানে দিনের আলো ফুটফুটে থাকতো অফিস থেকে বের হলেও, এখন ঘন অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করবে।
সময় পাল্টেছে। শীতের একাল-সেকালে সময়্রর ফারাক অনেক। আনুমানিক সময়টা এখন হিসেব করে লাভ নেই। তবে প্রায় ২০ বছর সীমানা ধরলেও শীতের সময়ের ফারাক এখন স্পষ্ট৷ কিন্তু অনুভূতিটা আগের মতোই রয়ে গেছে। সেই অনুভূতির স্পর্শ দেয়ার জন্যেই গুছিয়ে আজকের এই লেখা:
প্রকৃতির ওপর শীতের প্রভাব
শীত এমনিতেও আমাদের জন্য বিশেষ ঋতু। অল্প সময়ের জন্য অবস্থান। প্রকৃতিকে অন্যভাবে সাজিয়ে ফেলে এই একটি ঋতু। রাতের রহস্যময়তা আর দিনের স্নিগ্ধতার সঙ্গে ক্রুর শীতের প্রভাবও রয়েছে। আজ থেকে বহু আগেও শীতের উপস্থিতি প্রকৃতিকে ছুয়েছে। এখনও ছুয়ে ফেলে। তবে পার্থক্য হয়েছে।
এখন শীত আসে অনেক দেরিতে। শহরে তো শীতই অনুভূত হয় না। আবার অনেক অঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। শুষ্ক চেহারা আর হিমশীতল অনুভব নিয়ে আসে শীত। এ সময় গ্রামবাংলা যেন শীতের চাদর মুড়ি দেয়। ভোরবেলা ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা থাকে। হিমেল হাওয়ায় হাড় কাঁপিয়ে শীত জেঁকে বসে। শীতের দাপটে প্রকৃতি নীরব হয়ে যায়। সবুজ প্রকৃতি রুক্ষ মূর্তি ধারণ করে। শীতের শুষ্কতায় অধিকাংশ গাছপালার পাতা ঝরে পড়তে থাকে। শীত তার চরম শুষ্কতার রূপ নিয়ে প্রকৃতির ওপর জেঁকে বসে। রুক্ষতা, তিক্ততা ও বিষাদের প্রতিমূর্তি হয়ে শীত আসে। শীতের তান্ডবে প্রকৃতি বিবর্ণ হয়ে পড়ে। শহরেও এই বিবর্ণতা এখন কংক্রিটের। কংক্রিটের অনেক দেয়ালে জমে থাকা স্যাতস্যাতে ও আশটে ভাব। অসুস্থতা। আগের তুলনায় এখন যেন অনেক ম্রিয়মাণ সব।
মিরপুরের দুয়ারীপাড়ায় আজ দীর্ঘ সতেরো বছর পরিবার নিয়ে থাকেন আসমা খাতুন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তিনি জানান, ‘বাসার পাশেই বোটানিক্যাল গার্ডেন। শীতের সময় সকালে পরিবর্তনটা চোখে পড়তো। তখন এত বাড়িও ছিলো না। কুয়াশা দেখা যেতো। এত মানুষের বাস ছিলো না। তাই শীত এলে অনেকে আড্ডা দিতো। গ্রামের মতো শহরেও আলাদা একটা পরিবেশ ছিল। এখন এত মানুষ। জায়গার অভাব। হাটারই জায়গা নেই। রাস্তায় বের হলে রিক্সা আর গাড়ির বিকট শব্দ। ওরকম আড্ডার সুযোগ কোথায়? ছেলেমেয়েরাও তো খেলতে পারে না।‘
সকালের কম্বলচাপা ঘুম
আজ থেকে বিশ বছর আগেও কম্বলচাপা ঘুমের ইচ্ছেটা ত্যাগ করা কঠিন ছিল। এখনও তেমনি। যদিও এখন অনেকেই ব্যস্ততার তাগিদে সকালে উঠেই বাইরে গিয়ে দেখে কুয়াশাঘেরা পথ। গাড়িঘোরার শব্দ কুয়াশা ভেদ করে আসে।
কেউ কম্বল, কেউ ল্যাপ আবার কেউ কেউ দুটোই। সারারাত ফ্যান চালানো হয় না। কয়েল জ্বালানোয় হয়। তার পোড়া ধোয়ার ঘ্রাণ। ঘুম থেকে উঠলে বোঝা যায়, শীত আছে। সেটা আগের কথা।
এখন সময় বদলেছে। আগের মতো টোটকা পদ্ধতিতে ঘর গরম রাখতে হয় না। অনেক উপায় রয়েছে। যদিও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল মান্নান একটু ভিন্নমত পোষণ করেন। ‘এখন তো শীতই টের পাই না। কেমন যেন হয়ে গেছে। আমাদের ক্যাম্পাসেও তো অনেক শীত থাকার কথা। সেটাও তো দেখি না। ২০১৯ এই হাড়কাঁপানো শীত ছিল। এখন তো তাও নেই। ঢাকায় গেলে গরম লাগে। কম্বলচাপা ঘুমের সুযোগ কোথায়? ঢাকায় তো অনেক আত্নীয় এখন শীতেও ফ্যান চালিয়ে ঘুমান।‘
শীতের ভোর
কুয়াশা সরের মতো আস্তর ফেলে ভোরে। গ্রাম কিংবা শহর দুই অঞ্চলেই শীতের ভোরটা একটা সাংস্কৃতিক স্মৃতি৷ তবে সময়ের বদল হওয়ায় এখন অনেক কিছুই বদলেছে। আজ থেকে আট বছর আগেও উত্তরার বাসিন্দা সাদিয়া তিশা ভোরে বের হতেন। ‘আমি তো স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হতাম। বের হতেই হতো। আমাদের মর্নিং শিফট। সকালে রাস্তা অনেক শান্ত থাকতো। অদ্ভুত এক পরিবেশ। আর এখন কেমন যেন। সকালেই বাসগুলো ব্যস্ত হয়ে যায়। আটটা বাজার আগেই বাসের ধোয়া আর শব্দ কুয়াশা উড়িয়ে দেয়। রাস্তায় এখন অনেক কষ্টে তালের রস খুঁজে বের করা লাগে। সবকিছু কেমন বদলে গেছে। বোঝানো কঠিন।‘
আগে সকালে কুকুরের ডাকের আওয়াজ দিয়ে ভোর শুরু হয়। আজও তাই। শীতে ভোরে প্রতিট শব্দই আলাদা করে শনাক্ত করা যায়। ভোরে ঘুম ভাঙলেই ঠাহর হয় মোরগও ডাকছে। পাখি ডাকছে। আজও তাই। তবে পরিবর্তন দেখা যায় রাস্তায় বের হলে।
আগে রাস্তায় খড়কূটো জ্বালিয়ে অনেকে ওম নেয়ার চেষ্টা করতো। শীতের ওই সময়ে মানুষ গল্প করে কিছুক্ষণ শীত তাড়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত থাকতো। এখন সবাই রাস্তায় সেভাবে জমায়েত করে না। সবাই চায়ের দোকানে জমা হয়। এক কাপ চা। তারপর সবাই যে যার ব্যস্ত হিসেবে।
পিঠাপুলির উৎসব
শীত মানেই পিঠা। তবে সেগুলো কথার কথা আজ। এখন শীত এলে রাস্তার মোড়ে ভাঁপার দোকান। চিতইয়ের দোকান। এসেছে পরিবর্তন। চিতইয়ের সঙ্গে হরেক পদের ভর্তা৷ অনেকে দোসা খেয়ে থাকেন। স্ট্রিটফুডের মতোই যেন। সারাবছরই চিতই পাওয়া যায়।তবে শীতে আলাদা আমেজ আনে। মিরপুর ছয়ে আনসার আলী আজ তিন বছর হলো পিঠার ব্যবসা করেন। ‘প্রথমে শুরু করছিলাম তো মানুষের চাহিদা দেইখা। মানুষ এখন ভর্তার জন্য আসে। দুধ চিতই এগুলো এখন আর বিক্রি হয় না। সবাই ডিম চিতই পছন্দ করতেছে। এইটা দিয়া ভালো ব্যবসা হয়। যারা দুধ চিতই করতে চায় তারা নিয়া যায়। আমাদের সময় তো হিসাব অন্য আছিল। চিতই মানে শইষ্যা ভর্তা আর শুটকি ভর্তা। এখন দশ পদ ভর্তা না থাকলে হয় না।‘
তবে আগের হিসেব ছিল আলাদা। পিঠাকে নিয়ে বাড়িতেও আয়োজন ছিল। বাড়ি বাড়ি প্রস্তুতি রাখা হতো। শীতের ছুটিতে গ্রামে যাওয়ার পর্ব। উৎসবটা ছিল পরিচিত। আজও এসব আংশিক হয়। উৎসবের আমেজ অত না।
মেলার আয়োজন
আগে শীত মানেই নানা মেলার আয়োজন। বহু জায়গায় ওরসের আয়োজন হয়। ধর্মীয় আমেজ হলেও তার সঙ্গে থাকে আলাদা মেলার আয়োজন।শীতে নানা পাড়ায় শীতের মেলার আয়োজন। এখন গ্রামে অনেক জায়গায় মেলার আয়োজন হয়। শহরে তার সংখ্যা খুব অল্প।
সময় পাল্টেছে। এখন হয় কনসার্ট। গানের উৎসব। তরুণ প্রজন্মের এই আয়োজনই এখনকার চল। পারিবারিকভাবে ঘোরার সেই আয়োজন অত নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে আয়োজিত এসব কনসার্ট বা কিছু মেলাই সম্বল নগরে। বরিশালের জাহিদ হোসেন জানান, ‘ঢাকায় বুটেক্সে চান্স পাওয়ার পর থেকেই থাকি। এখানে তো মেলা নেই। আমাদের ওখানে শীতের সময় অনেক মেলার আয়োজন বসতো। ঢাকায় এখন কনসার্ট। ঐখানে আসলে শীতের আমেজের চেয়ে মেকি আয়োজনই বেশি।‘
ব্রাহ্মনবাড়িয়া সরাইলের বাসিন্দা আজহারুল আবেদিনও এখন ঢাকায়। তিনি বলেন, ‘আমার আব্বুর আপন মামাতো দুই ভাই পীর। তাদের মুরিদ অনেক। প্রতিবছর শীতে তাদের ওরসের আয়োজন হয়। তখন সারা গ্রামে আলোর ব্যবস্থা আর মেলা বসে। অনেক দূর থেকে হাজারো মানুষ ছোট এই গ্রামে জমা হন। ভালো লাগে। চালের পিঠা আর মুরীদদের আনা মাংসের ঝোল সবাইকে দেয়া হয় রান্না করে। এই সময় কোনো বিভাজন থাকে না। এখন একটু বদল হয়েছে। আমি শেষ তিন বছর যাইনি। শুনেছি এখন মেলার অংশটা ছোট হয়ে গেছে।
জীবনযাপনের পরিবর্তন
শীত আসলেই এক ধরনের মানুষ গোসল করেন না। সময় যেমনই হোক এই অভ্যাস বদলায়নি। তবে আগে অনেকটা সম্ভব হলেও এখন এত সহজে সবাই পারে না। যদিও এখন ওয়াটার হিটার বা অন্যকিছু দিয়ে হলেও কাজ চালিয়ে দেয়া যায়। সে না হয় গেলো। এখন গোসল করার অনেক উপায় রয়েছে।
আগে শীতের খাদ্যাভ্যাসের বিষয় ছিল। বাড়িতে মজাদার সব্জির ধুম। প্রতিদিনই গরম গরম খাবার। এখন অবশ্য অনেক বাড়িতে সারাবছরের মতোই আয়োজন। এত কিছুর প্রয়োজন হয় না। শীতকে ঘিরে রাখা পরিকল্পনা এখন অতটাও না। তবে এখন ভ্রমণের সুবিধা কিছুটা পাওয়া যায়। তাছাড়া জীবনের ব্যস্ততা সারা বছরের মতোই।
ব্যাডমিন্টনের ধুম
শীত এলেই ব্যাডমিন্টনের ধুম। সবাই আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। কিন্তু এখন এই প্রস্তুতিতে একটু ভাটা পড়ে আছে। আগে পাড়া বা মহল্লায় প্রতিটি রাস্তায় কোর্ট কাটতে দেখা যেতো। কেউ গাড়ি, রিক্সা বা বাইক নিয়ে এলাকায় ঢুকলে বিপত্তি। সব পথ বন্ধ। রাস্তা আলোকিত কোর্টের আলোয়। প্রতিবছর খেলার আয়োজন হলেই আসাদগেটের সরোয়ার জাহান আলিম ব্যাটমিন্টন কোর্ট কাটতেন। তিনি জানান, ‘আমরা ছোটবেলায় যখন কোর্ট কেটেছি তখন তো হিসেব ছিল অন্য। এলাকার সবাই আসতো। সবাই টাকা দিত। মিলেমিশে কোর্ট হতো। এখন সবার আলাদা ব্যাট, সবার আলাদা নির্ধারিত চাঁদা। আর সবখানে কোর্ট কাটাও যায় না। অদ্ভুত! করোনার আগে থেকেই পরিবর্তনটা বুঝতে পারছিলাম।‘
এখন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের সুযোগ বেড়েছে। খেলার পরিসর কমেছে। সব রাস্তাই এখন গুরুত্বপূর্ণ। তাই চাইলেও কোর্ট বানানো যায় না। তাই অনেকে টাকা খরচ করে নিজস্ব জায়গাতেই খেলেন। অথচ আগে এই ব্যাডমিন্টনের মাধ্যমেই কত নতুন বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো।
শীতের জামা কেনার ধুম
এই একটা জিনিসে দুই সময়েরই মিল আছে। অবশ্য শীতের জামাকাপড় কেনার ক্ষেত্রে এখন ফ্যাশন হাউজ বা অনলাইন শপের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি। আগে পরিবারে বাবার সঙ্গে মিলে জামা কেনা হতো। সবাই পরিকল্পনা করে পুরো পরিবারের জামা কিনে নিতো। সেই সমন্বয় কিছুটা হলেও এখন হারিয়েছে। তাও কেনাকাটার আমেজটা রয়েছে। ফুটপাতেও রয়েছে সেই আমেজ।