বিয়ের দাবিতে অনশন: নারীর আত্মসম্মান প্রশ্নবিদ্ধ
সম্প্রতি সমাজে নানাবিধ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেই চলেছে তন্মধ্যে বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়িতে অবস্থান একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা। মানুষ কতোটা বিবেকহীন, জড়বস্তুতে পরিণত হলে এমন মেরুদণ্ডহীন প্রাণীতে রূপ নিতে পারে! নারী-পুরুষ লিঙ্গভেদে উভয়ের পরিচয় মানুষ। কিন্তু এই মানুষের মধ্যেই রয়েছে রকমফের। কেউ মনুষ্যত্ব, বিবেক, নীতি-নৈতিকতার দ্বারা পরিচালিত; কেউবা এর ধারের-কাছেও নেই! মনের দিক থেকেও তাই বিশেষ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু নারী-পুরুষের মধ্যে যখন কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তখন একপক্ষের সায় না থাকলে তা খুব একটা বেশিদূর এগোতে পারে না। মূলত সম্পর্কই গড়ে ওঠে না।
কিন্তু বিভিন্ন মানসিকতাকে কেন্দ্র করে নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে যখন সম্পর্ক হয়ে যায়, হতে পারে সেটা খুব একটা হৃদয়ঘটিত নয়, তখন সম্পর্কটা টেনে নিয়ে বেড়ানো উভয়ের পক্ষে কাঁটার মতো! একজন পুরুষের পক্ষে একটি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা যতটা সহজ, নারীর পক্ষে ততটা নয়! এমনটাই মনে করে অধিকাংশ নারী! প্রেমের মতো হৃদয়ঘটিত সম্পর্কও আজ যেন ঠুনকো। প্রায় বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়িতে নারীর অবস্থান কিংবা অনশনের খবর আসে গণমাধ্যমে। এমনকি আমরণ অনশনের খবরও গণমাধ্যমের সুবাদে জানতে পারি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী জানা যায়, স্ত্রীর স্বীকৃতির দাবিতে নেত্রকোনার তরুণীর কুমিল্লার দেবীদ্বারে প্রেমিকের বাড়িতে এসে অবস্থান নিয়েছে।
মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে উপজেলার পৌর ৩ নম্বর ওয়ার্ড ফতেহাবাদ পশ্চিম চান্দারপার গ্রামের মৃত মোবারক হোসেনের বাড়িতে আওয়ামী লীগ নেত্রী কামরুন্নাহার শিল্পী বেগমের ছেলে এমরান হোসেন ইমরানের স্ত্রীর মর্যাদার দাবিতে অবস্থান নিয়েছে বলে জানিয়েছেন তরুণী (২৩)। ক্রমাগত সমাজে এ ধরনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। কিন্তু এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে একদিকে নারীর অসচেতনতা অন্যদিকে পুরুষের বিশ্বাসঘাতকতা।
প্রশ্ন হলো, সম্পর্ক তো দুজনের হৃদয়ঘটিত ব্যাপার। সেখানে একজন পিছিয়ে পড়লে কিংবা সম্পর্ক অস্বীকার করলে আরেকজনকে কেন জনসম্মুখে তার দাবি নিয়ে দাঁড়াতে হবে? নারীকে কেন প্রেমিকের বাড়িতে অবস্থান করে অনশনে যেতে হবে? কেন নারীরা নিজেদের মর্যদা সম্পর্কে ভাবে না! আজকের নারীরা শিক্ষা-দীক্ষা রুচিতে উন্নতি লাভ করেছে। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই এর ন্যূনতম লক্ষণ দেখা যায় না। যদি নিজের মূল্য, যোগ্যতা ও দক্ষতার ওপর আস্থা থাকতো, তবে নারীরা বিয়ের জন্য প্রেমিকের বাড়ি গিয়ে অনশন করতো না। বরং চিত্র কিছুটা ভিন্নই হতো! আমরা সমাজে উল্টো চিত্র দেখতে পেতাম।
এক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় তুলে ধরা জরুরি, এ সব নারী কি বিবেচনা করে দেখেছে, কখনো পুরুষটির বাড়িতে কেন অবস্থান নিচ্ছে! পুরুষটি যদি আদৌও তাকে ভালোবাসে, তবে তো বাড়িতে গিয়ে অনশনটা প্রলাপের মতোই শোনাবে! নারী কেন নিজেকে এত সস্তা ভেবে, নিজের আত্মসম্মান বিকিয়ে দিতে চায়! সামান্যতম মূল্যবোধও কি তাদের মধ্যে নেই? এক্ষেত্রে অনেক নারী হয়তো গভীরভাবে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তাহলেও বলবো, সম্পর্ক মানেই তো দুজনের পূর্ণ সম্মতি। তবে একজন যদি প্রতারণা করে, সেক্ষেত্রে আরেক জন আইনি সহায়তা নিতে পারে।
কিন্তু মনুষ্যত্ব খুইয়ে প্রেমিকের বাড়িতে অবস্থান করতে পারে না। প্রেমিকের বাড়িতে অবস্থানকে কেন্দ্র করে নারীর আর একটি বিষয় চোখে পড়ে। এটি হলো, এই ধরনের নারীরা পুরুষের ওপর বেশি নির্ভরশীল। তাই একজন পুরুষ সম্পর্ক অস্বীকার করলে তার পায়ে পড়ে হলেও তাকে সম্পর্কে আবদ্ধ করতে চায় ‘অবলা’ নারীরা। নারীর এই নির্ভরশীলতা অনেকটা আর্থিক নির্ভরশীলতা! এ সব নারী মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে, পুরুষ ছাড়া তাদের গতি নেই।
তারা জীবনকে পরিচালিত করতে পারবে না। নিমিষেই থমকে যাবে জীবনের জটিলাবর্তে! তাই তারা পুরুষকে আঁকড়ে ধরে শেষ নিঃশ্বাসটুকুও ত্যাগ করতে চায়। কিন্তু তারাই যদি পড়াশোনা করে নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে ওঠে, তবে তাদের জীবনে কখনোই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আসবে না। সম্পর্কের জের ধরে নারীদের প্রেমিকের বাড়িতে অবস্থান করার আরও একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। সেটি সামাজিক নিরাপত্তা!
এই মানসিকতার নারীরা সামাজিকভাবে নিজেদের নিরাপদ রাখতেই পুরুষের হাতে-পায়ে ধরে হলেও সম্পর্কে আবদ্ধ রাখতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যেখানে সম্মান-শ্রদ্ধা-ভালোবাসার বালাই নেই, সেখানে শুধু সামাজিক নিরাপত্তা কিভাবে বড় শর্ত হয়ে ওঠে! আজকের নারীকে পরনির্ভরশীলতা, পুরুষ নির্ভরশীলতার মতো বদভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাকে হয়ে উঠতে হবে, আত্মনির্ভরশীল, স্বাবলম্বী। তাহলে আর নিজেকে অসহায়-অবহেলা ভাববে না। আর এজন্য নারীকে অবশ্যই কঠোরভাবে নিজেকে গড়ে তোলার সাধনা করতে হবে।