কাঁখে কলস, পুরুষ অলস
পুকুড়পাড় থেকে নারী কাঁখে কলস নিয়ে আসবে এমন গ্রামীণ চিত্র আমাদের চোখে দেখা না হলেও মনে ঠিকই ভাসে। এই না হলে গ্রামীণ দৃশ্য! তবে বাস্তবতা এখন একটু ভিন্ন। গ্রামীণ জীবন থেকে আমরা এখন চলে এসেছি নগরায়ণের যুগে। আর বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে সুপেয় পানির সংকট আমাদের দেশে অত জটিল আকার ধারণ না করলেও পরিশ্রম কম নয়। নিরাপদ পানির অভাব এবং শহরের অনেক অঞ্চলে এখনো পানি সংগ্রহের জন্য মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হয়। আর এই ভোগান্তির দায় বহন করতে হয় নারীকে।
বাংলাদেশে পানি সংগ্রহের ক্ষেত্রে নারীদের দায়বদ্ধতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় ১০ গুণের বেশি। খবরটি দেশের কোনো গণমাধ্যমের নয়। বরং জাতিসংঘের দুই সংস্থা ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রামের (জেএমপি) প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নারী ও মেয়েরা পুরুষদের তুলনায় পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহ করতে ১০ গুণ বেশি সময় ব্যয় করেন। অবশ্য বিশ্বব্যাপী নিজের পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহের কাজটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীরাই করে থাকেন, যেখানে এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ এবং প্রতিদিন এই কাজের পেছনেই তাঁদের অনেক সময় ব্যয় হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাজস্থানে পানি সংগ্রহের খবর হয়তো এখনো অনেকের অজানাই। আবার আফ্রিকায় এই অবস্থা যে কতটা ভয়াবহ তা অনেকেই কল্পনা করতে পারবেন না। বাসগৃহে পানির সংস্থান না থাকা প্রতি ১০টি পরিবারের মধ্যে ৭টিতে পানি সংগ্রহ নারী ও মেয়েদের দায়িত্বে থাকে। সামান্য একটি বিষয় তবে ভাবনার অনেক বিষয় রয়েছে।
মেয়েরা শুধু পানি সংগ্রহে বেশি সময়ই দেয় না তারা পানিও কম খায়। উপকূলীয় এলাকায় এটি বেশি ঘটে। সেখানে সুপেয় পানি আনতে যায় মেয়েরা। কিন্তু এক বা দুই কলসের বেশি পানি তো আনতে পারে না। তাই পানি তাকে কম খেতে হয়। কারণ কম পড়লে তাকেই আবার যেতে হবে। নারীদের আরও ভাবনা থাকে, পানি কম হলে তার স্বামী বা সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যের অসুবিধা হবে।অর্থাৎ গ্রামীণ অঞ্চলে স্যানিট্যাশন এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যার ক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যাই কেন বেশি তার একটি কারণ অন্তত শনাক্ত করা গেলো। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুপেয় পানির সংকট তো রয়েছেই। একইসঙ্গে রয়েছে দাবদাহ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এসব পরিবর্তন সরাসরি দেহের ওপর প্রভাব ফেলে। নারী যখন পানি কম পান করবেন তার বিরূপ প্রভাব তার শরীরে নানাভাবে পড়তে পারে। সুস্থ থাকার জন্য নিরাপদ পানি পান করার বিকল্প নেই। একইসঙ্গে শ্রমসাপেক্ষে নারীকে নিরাপদ পানি পানও করতে হয়। সেই চাহিদা তাদের পূরণ হয় না।
এই প্রতিবেদনটি যদিও পানি সংগ্রহের বিষয়টিকে নিয়ে তুলে ধরেছে কিন্তু এর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট কিন্তু ব্যাপক ভাবনার। পানি সংগ্রহের জন্য একটি মেয়ের একটি করে ধাপ এগিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো পড়াশোনা, খেলাধুলা ও নিরাপত্তা থেকে তার একটি করে ধাপ দূরে সরে যাওয়া। অনিরাপদ পানি, অনিরাপদ টয়লেট ও বাড়িতে হাত ধোয়ার অনিরাপদ ব্যবস্থা মেয়েদের কাছ থেকে তাদের সম্ভাবনা কেড়ে নেয়, তাদের সার্বিক কল্যাণকে ঝুঁকিতে ফেলে এবং দারিদ্র্যের চক্রকে স্থায়ী করে। যদিও বিষয়টি অনেকেই এখনই বিশ্বাস করতে রাজি হবেন না। সেজন্যই প্রতিবেদনের কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরা হবে। তবে এটুকু সত্য যে নারী তার দিনের একটি বড় অংশ পানি সংগ্রহে ব্যয় করলে তার জীবনের অন্য কাজ করার সময় কমবেই। সময় ত অফুরন্ত নয়। সমস্যা সবসময়ই বেশি।
বিশ্বব্যাপী ১৮০ কোটি মানুষ এমন ঘরবাড়িতে বসবাস করে, যেখানে বাসগৃহে পানির সংস্থান নেই। এ ধরনের প্রতি ১০টি পরিবারের মধ্যে ৭টিতে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী নারী ও মেয়েরা প্রাথমিকভাবে পানি সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করেন। আর এ ধরনের প্রতি ১০টি পরিবারের মধ্যে ৩টিতে তাঁদের সমবয়সী পুরুষ ও ছেলেদের এই দায়িত্ব পালন করতে হয়। সেটাও ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন হতে পারে। ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েরা (৭ শতাংশ) ১৫ বছরের কম বয়সী ছেলেদের (৪ শতাংশ) তুলনায় পানি সংগ্রহের দায়িত্ব বেশি পালন করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী ও মেয়েদের পানি সংগ্রহের জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়, যা তাদের পড়াশোনা, কাজ ও অবসর যাপনের সময় কমিয়ে দেয় এবং পথে তাদের শারীরিক আঘাত পাওয়া ও বিপদে পড়ার ঝুঁকিতে ফেলে। পানি সংগ্রহের জন্য দীর্ঘ সারিতে তাদের অপেক্ষা করতে হয়। একটানা দাঁড়িয়ে থাকার স্ট্রেস এবং অনেক সময় তীব্র রোদে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম নয়। সেখানে যোগ হচ্ছে তাদের পানি পান করার সুযোগ একেবারেই নেই। আমাদের দেশের অনেক অঞ্চলে নদীর পানির লবনাক্ততা বাড়ছে। এটি একটি চলমান সমস্যা। খুলনা অঞ্চলেই শহরাঞ্চলে পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা হলেও নদীবিধৌত অঞ্চলের অবস্থা খারাপ। এটি সম্প্রতি আল জাজিরার একটি উপসম্পাদকীয়তে প্রকাশিত হয়েছে।
জাতিসংঘের ঐ প্রতিবেদনটি মনোযোগের আরও কিছু বিষয় তুলে ধরে। প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে যে ৫০ কোটির বেশি মানুষ এখনো অন্য পরিবারের সঙ্গে স্যানিটেশন সুবিধা ভাগাভাগি করে, যা নারী ও মেয়েদের গোপনীয়তা, মর্যাদা এবং নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ২২টি দেশে পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, যেসব পরিবার নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে টয়লেট ব্যবহার করে, সেসব পরিবারের নারী ও মেয়েরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাতের বেলায় একা হাঁটাচলা করতে পুরুষ ও ছেলেদের তুলনায় অনিরাপদ বোধ করেন এবং যৌন হয়রানি ও অন্যান্য নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হন। করোনা পরবর্তী বিশ্বে পানি এবং স্বাস্থ্য সতর্কতা অনেক জরুরি। বর্ষাকালে ইনফ্লুয়েঞ্জা, গ্রীষ্মে ডায়রিয়া এবং বিভিন্ন মৌসুমে পেটের পীড়া থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে নিরাপদ পানির পাশাপাশি স্যানিটেশনের ব্যবস্থাও জরুরি। একথাও মনে রাখতে হবে, গ্রামীণ অঞ্চলে যখন কয়েকটি পরিবার একই ল্যাট্রিন ব্যবহার করে তখন নিরাপদে ও ব্যক্তিগতভাবে তাদের মাসিক ব্যবস্থাপনার সুযোগ সীমিত করে। উপাত্ত পাওয়া যায়, এমন ৫১টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের নারী ও কিশোরী এবং যারা শারীরিকভাবে অক্ষম, তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শারীরিক পরিচ্ছন্নতা ও পোশাক বদলের জন্য ব্যক্তিগত গোপনীয় স্থান থাকে না। এটি একটি বড় সমস্যা অবশ্যই। আমরা বলছি আধুনিক সুবিধা আমাদের দোড়গোড়ায়। কিন্তু প্রান্তিক অঞ্চলের অবস্থা কতটা করুণ তা এই প্রতিবেদনই বলে দেয়।
ডব্লিউএইচওর পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক মারিয়া নেইরা বলেন, ডব্লিউএইচওর সাম্প্রতিক তথ্য একটি কঠোর বাস্তবতা তুলে ধরে: অপর্যাপ্ত পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধির কারণে প্রতিবছর ১৪ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। নারী ও মেয়েরা ডায়রিয়া ও তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের মতো শুধু ‘ওয়াশ’ সম্পর্কিত সংক্রামক রোগের সম্মুখীন হয় না, তারা এর বাইরেও বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হয়। কারণ, যখন পানি সংগ্রহ বা শুধু টয়লেট ব্যবহার করার জন্য তাদের বাড়ির বাইরে যেতে হয়, তখন তারা হয়রানি, সহিংসতা ও আঘাতের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। বর্তমানে প্রায় ২২০ কোটি মানুষ বা প্রতি ৪ জনের মধ্যে ১ জনের এখনো বাড়িতে নিরাপদে সংগ্রহ করা খাওয়ার পানির অভাব রয়েছে। ৩৪০ কোটি মানুষ বা প্রতি ৫ জনের মধ্যে ২ জনের নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা নেই। প্রায় ২ কোটি মানুষ বা প্রতি ৪ জনের মধ্যে ১ জন বাড়িতে সাবান ও পানি দিয়ে তাদের হাত পরিষ্কার করতে পারে না।
করোনা মহামারি আমাদের এক ভয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। নারী গৃহস্থালী অনেক কাজের দায়িত্বে থাকেন। তিনি অসুস্থ হলে এবং সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত হলে তার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। জনসংখ্যাবহুল দেশে এই বিষয়টিকে নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। যদিও পানির বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ চলছে। কিন্তু তা শহরকেন্দ্রিক না হয়ে প্রান্তিক অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়া জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন ও সুপেয় পানির সংকটের বিষয়ে আমরা গাফিলতিই করছি। সময় খুব অল্প। কাজ করতে হবে দ্রুত।