Skip to content

২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সন্তানের পরীক্ষার ফলেই অভিভাবকের সম্মান নির্ভর করে না

বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে গড় শিক্ষার হার অভূতপূর্বভাবে বেড়েছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অভিভাবকদের প্রত্যাশা। শিক্ষার্থীরা কতটা পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে গড়ে উঠেছে তার ওপর যতটা মনোযোগ পরিবার, সমাজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের থাকা উচিত, তার কিছুই লক্ষণীয় নয়। বরং পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাপকাঠি এখন ফল। সন্তান কতটা সার্থক এবং কতটা ব্যর্থ তা মাপা হয় এই নিক্তিতে। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কী সন্তানেরফলের ওপরই তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে? সেইসঙ্গে পারিবারিক সম্মানও কি শুধু সন্তানের পরীক্ষার ফলের সঙ্গে জড়িত?

আমাদের পরিবার তথা সর্বোপরি সমাজকে ঠিক যতটা এগিয়ে যাওয়ার তকমা আমরা দিই আদৌ কি তা সঠিক? শিক্ষার হার বেড়েছে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে বলেই। কিন্তু বর্তমান সমাজের দিকে লক্ষ করলে সহজেই দৃষ্টিগোচর হয় শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষা কতটা ঘাটতি! প্রত্যেক বছর অসংখ্য শিক্ষার্থী ডিগ্রি অর্জন করছে। পিতামাতা বা অভিভাবকেরা সেই ডিগ্রিকেই জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি বলে গণ্য করছেন। সমাজের মধ্যে একধরনের রেস শুরু হয়েছে যে শিক্ষার্থীরা অধিকতর ভালো ফল অর্জন করবে তারাই টিকে থাকবে। ফলে অভিভাবক শ্রেণির মধ্যেও শুরু হয়েছে দৌঁড় প্রতিযোগিতা। যে বা যারা তাদের ডিগ্রি বা কাঙ্ক্ষিত ফল দিয়ে সামনের সারিতে থাকবেন তারাই কেবল পৌঁছাতে পারবেন। বাকিরা যারা পেছনের কাতারে থাকবেন, তারা যেন এ সমাজের কাছে, পরিবারের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে উঠছেন।

এদিকে পরিবার এবং সমাজের এত চাপ সহ্য করে ওঠা শিক্ষার্থীদের পক্ষে সবসময় সম্ভব হয়ে উঠছে না। তারা তখন পরিবার এবং সমাজের চাহিদা পূরণ করতে না পেরে হতশা, বিষাদে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছে। বিগত রেকর্ডের দিকে লক্ষ করলে বোঝা যায়, এসএসসি; এইচএসসি বা ভর্তিযুদ্ধ কিংবা চাকরি পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফল না করার কারণে আত্মহত্যা করেছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। যারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন তারা এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন মূলত আমাদের পরিবার, সমাজের ভুল চিন্তাধারা কারণে। কিছুদিন আগে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থী ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। এইচএসসি পরীক্ষা খারাপ হওয়ায় নামাজরত অবস্থায় এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু এছাড়া পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফল না করায় আত্মহত্যা তো খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে । এরকম অসংখ্য ঘটনা উপস্থাপন করা যাবে। এর নেপথ্য কারণ কী?

সন্তানের পরীক্ষার ফলের ওপর তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না, এটা খুব জোরালো কণ্ঠে বলা মুশকিল। কারণ আমরা জানি, স্বনামধন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে ভালো ফল একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আমাদের অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে ভালো ফল জীবনের একটি অংশ মাত্র। পুরো জীবন নয়। তাই শুধু একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান, বুদ্ধির পরিমাপক হিসেবে ফলকে গুরুত্ব দেওয়া চলে না। এমন অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী মনীষী ছিলেন বা আছেন যারা স্কুলের গণ্ডি পেরুতে পারেননি বা পুঁথিগত বিদ্যা যাকে বলি তা ছিল না। কিন্তু এই মনীষীরা তাদের জ্ঞান দিয়ে পুরো সমাজকে আলোকিত করেছেন। জাগিয়ে তুলেছেন মানব সম্প্রদায়কে। সমাজের কুসংস্কার, অন্ধত্ব দূর করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন এবং আজও করে যাচ্ছেন। সমাজের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু তাই বলে সেই পরিবর্তনের জোয়ারে গা ভাসিয়ে পাল্লা দিয়ে নিজের সন্তানকে সম্মানের হাতিয়ার বানানো উচিত নয়। প্রত্যেক ব্যক্তির স্বতন্ত্র্য গুণ আছে। কে কোন বিষয়ে পারদর্শী সেদিকে নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

অনেকেই মনে করেন সন্তানের পরীক্ষার ফল ভালো নাহলে সুধী মহল থেকে শুরু করে বন্ধু মহলে তার মাথা হেঁট হয়ে যাবে। সঞ্চিত সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। আর এ কারণে এক অন্ধ প্রতিযোগিতা চলছে আমাদের সমাজে। সন্তানকে যোগ্য এবং দক্ষ মানুষরূপে নয় বরং সন্তানের একাডেমিক ফল কতটা ভালো হল সেদিকেই সবার লক্ষ। আর এই সোনার হরিণ ধরতে আমাদের অভিভাবক সমাজ এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছে যে প্রকৃত জ্ঞানের জগতে সন্তান থাকছে অন্ধ। বাস্তব জগতে এসে লড়তে তারা সাহস পাচ্ছে না। কিছু বই পড়ে উগরে দিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করছে। আর এর ফলে আপাতদৃষ্টিতে তারা এগিয়ে গেলেও সুশিক্ষিত হয়ে উঠছে না।

সমাজের দিকে লক্ষ করলে আমরা অনুধাবন করতে পারবো কী প্রচণ্ড পরিমাণে গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, পারবারিক নিপীড়ন, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, সামাজিক অবক্ষয়ের সম্মুখীন জাতি। তবে শিক্ষা কোথায়? মানুষ হিসেবে মানুষের মূল্য কী? কেনোই বা সমাজে এত বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে?

এর কারণ হিসেবে প্রথমেই বলা চলে আমরা এখন মানবিক বোধসম্পন্ন হওয়ার কথা ভাবতেও ভুলে গেছি। আগে যেমন স্কুল, কলেজ এবং পরিবারগুলোতে সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা দেওয়া এখন তা হয় না। এখন সবাই এক মহত্তম জীবন খুঁজে চলে। আর তা হচ্ছে কতটা ভালো ফল করবেন। কিভাবে বহুমূল্যের চাকরিটি হাতিয়ে নিতে পারবেন। এর জন্য যত ধরনের তদবির করা লাগে তা অভিভাবক পর্যায় থেকে আমাদের সমাজ করে থাকে। কিন্তু একটিবারের জন্য অভিভাবকদ্বয় ভাবেন না তার সন্তান এই দৌঁড়ে কতটা মানুষ হয়ে উঠছে!

একটা সময় আমাদের পূর্বজরা যৌথ পরিবারে বাস করতেন। তাদের মধ্যে ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধা, মমতা। কিন্তু এখন সবাই একক পরিবারের প্রতি ঝুঁকেছে। কিছুটা নগরায়নের ফল আর বেশিরভাগই স্বদিচ্ছার অভাব। নীতি-নৈতিকতা, শ্রদ্ধাবোধ যেন এখন আকাশের চাঁদের মতোই দূর বস্তু। গভীরভাবে ভেবে দেখুন সমাজ কিন্তু তার আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে, পিতামাতা তার সন্তানের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান হিসেবে চাচ্ছে সে বড় হোক। অনেক টাকা এবং নাম কামাক। তা নাহলে সমাজে মুখ দেখানো দায়! কিন্তু এই পিতামাতাই বৃদ্ধ বয়সে স্বপ্নের রাজপুত্র বা কন্যার কাছ থেকে বিতাড়িত হচ্ছেন। আশ্রয় হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম!

এসব কিছুর জন্য দায়ী প্রথমত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে উঠেছে যেখানে দক্ষ, যোগ্য মানুষের চেয়ে উগরে দেওয়া সার্টিফিকেটের মূল্যায়ন বেশি। আর এই মূল্যায়নের ফল ভয়াবহ। ডাক্তারি পাশ করে একজন ডাক্তার তার সেবাধর্ম ভুলে হয়ে উঠছে কশাইসম। ভুল চিকিৎসা পদ্ধতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ জনগণ। কেউ অপারেশন করতে গিয়ে ভুলবশত পেটের মধ্যে গজ-কাঁচি রেখেই সেলাই দিচ্ছেন! কেউবা খৎনা করাতে গিয়ে গলার টিউমারের অপারেশন করে দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ভুল রিপোর্ট প্রদান করে রোগীকে মানসিকভাবে বিভ্রান্ত, বিপর্যস্ত করে তুলছেন। শুধু ডাক্তারি পেশায় নয় সব পেশায় এখন ছলচাতুরি। শিক্ষাক্ষেত্রে এর ভয়াবহতা আরও বেশি। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে নামমাত্র মূল্য শিক্ষা কেনার ব্যবস্থা চলছে। বেসরকারি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার নামে চলছে প্রহসন। শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবার মধ্যে ঔদাসিন্য! এরূপ সবক্ষেত্রেই অস্তিত্বশীল পরিবেশ। এর নেপথ্য কারণ শুধু একটাই অভিভাবকদের একমাত্র ভালো ফলের আশা। এই আশায় তারা এতটাই মোহাবিষ্ট যে সন্তানকে মানুষ হিসেবে নয় একটা টাকার মেশিনে রূপান্তরিত করতে চান। এর জন্য ভালো কোচিং, ভালো স্কুল, ভালো পরিবেশ যতটা সাধ্য তার বেশিই দিতে চেষ্টা করেন অভিভাবকেরা। সেইসঙ্গে যদি তারা শুধু ফলাফলকে গুরুত্ব না দিয়ে মানুষ হয়ে ওঠাকে গুরুত্ব দেন তবে হয়তো জাতির দৈন্যদশা কমবে।

শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া জরুরি এর পাশাপাশি আমাদের পরিবার এবং সমাজের মাঝে গজিয়ে ওঠা মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যেখানে আমাদের সন্তানেরা পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার দীক্ষা গ্রহণ করবে। শুধু ফলের পিছনে ছুটে মনুষ্যত্ব, বিবেক খুইয়ে একটা যন্ত্রমানবে পরিণত হবে না। পিতা- মাতা তথা অভিভাবকমণ্ডলী সন্তানকে সম্মান আনয়নের হাতিয়ার রূপে গড়ে তুলবেন না। পারিবারিক সম্মান, ঐতিহ্য রক্ষার্থে বাড়তি বোঝা চাপিয়ে সন্তানকে ভারবাহী করে তুলবেন না। একজন মানুষের পাঁচ কেজি বহন করার ক্ষমতা আছে সেখানে যদি পরিবারের সম্মান, সামজিক মান- মর্যাদা বৃদ্ধি, দায় চাপিয়ে কুড়ি কেজিসম ভার বহন করতে দেওয়া হয় তবে অবশ্যই তা হিতে বিপরীত হবে। তাই সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া দায় থেকে তাদের পরিত্রাণ করতে হবে। পরিবার, সমাজকে বিশ্বাস করতে হবে সন্তানের পরীক্ষার ফল কখনোই পারিবারিক সম্মান আনয়ন করতে পারে না। বরং সন্তান কতটা পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠলো তা অনেক বেশি অর্থবহন করে।

পরিবার -সমাজের এই অসুস্থ, অন্ধ, দীন-হীন প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। পরীক্ষার ভালো ফল সন্তানকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তুলতে পারে না। দক্ষ, যোগ্য করে তুলতে পারে না। পরীক্ষার ভালো ফল একটা নম্বরধারীর সার্টিফিকেট দিতে হয়তো পারে। আর সেই সার্টিফিকেট জীবনের ক্ষুদ্র একটি অংশ পুরো জীবন নয়। তাই মানবিক, সৎ,যোগ্য, দক্ষ, বিবেক ও মনুষ্যত্বসম্পন্ন মানব সন্তান গড়ে তুলতে প্রকৃত শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। একমাত্র ভালো ফলই যেন কোনো পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজের কাম্য না হয়৷ সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক আমাদের সন্তানেরা এই হোক ব্রত।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ