Skip to content

৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | সোমবার | ২২শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হ‌ুমায়ূনের গৌরীপুর জংশন: আমাদেরও

হ‌ুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮- ১৯ জুলাই ২০১২) -এর উপন্যাস “গৌরীপুর জংশন” (১৯৯০) আশির দশকের একেবারে শেষ ভাগে রচিত। উপন্যাসের পটভূমি একটি ছোট রেল স্টেশন। ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর স্টেশনই এ উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। এই উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি পাঠ করে কবি নির্মলেন্দু গুণ এর নামকরণ করেন ‘গৌরীপুর জংশন’।

স্টেশন-জীবনের প্রতিদিনকার বাস্তবতাই এ উপন্যাসে খুব সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। ছোট ছোট নানা ঘটনা উপন্যাসটির রচনাকালের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছে দারুণভাবে।

ভালোবাসা, মায়া, দুঃখ-কষ্ট, শঠতা, দুর্নীতি, বিশ্বাসঘাতকতা মিলে গৌরীপুর স্টেশনের পাত্রপাত্রীরা এমন এক বাস্তবতা তৈরি করেছে যা মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। গল্পগুলো চেনা মনে হলেও পুরো পরিস্থিতি এবং পরিবেশ মিলেমিশে এর চরিত্রগুলো ভিন্ন এক জগৎ নির্মাণ করেছে।

মূলত উপন্যাসটি মধ্যবিত্তের চোখের সামনে থাকা ভিন্ন এক জগৎ যা প্রতিনিয়ত দেখলেও সাধারণের উপলব্ধির বাইরে। এমনই এক বাস্তবতার পর্দা উন্মোচন করেছেন লেখক। এই উপন্যাসে ঔপন্যাসিক হুমায়ূন একেবারে ভিন্ন ঘরনার হয়ে উঠেছেন। সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির জীবনই এর মূল উপজীব্য। যারা সাধারণের মধ্যে মিশে থাকলেও সাধারণ জনমানব নয়। তাদের দুঃখ-কষ্ট-জীবনযন্ত্রণাগুলো অন্যকে কাঁদায় না। তারা পরস্পরের প্রতি হিংস্র হয়ে ওঠে নিজের পেটের তাগিদে। একে অপরকে খাবলে খেতে চায় শুধু একটু খেতে পাওয়ার আশায়। এই উপন্যাসের প্রত্যেক পাত্র-পাত্রীই এক কঠিন জীবনসংগ্রামে লিপ্ত।

“গৌরীপুর জংশন”এর প্রধান চরিত্র জয়নাল। সে গৌরীপুর স্টেশনে বসবাসরত মধ্যবয়সী কুলী, যার যৌবন বিগত এবং ‘এখন যার দশা কোমর-ভাঙা কুকুরের মতো’। তিন মণ চালের বস্তা কোমরে পড়ে কোমর ভেঙে যাওয়ার পর কুলীর জীবন ত্যাগ করেছে। কিন্তু স্টেশন ত্যাগ করতে পারেনি। কারণ কোথায়ই বা যাবে সে। জয়নাল বর্ণিল একটি চরিত্র। স্টেশনের অন্য সব চরিত্রের মতোই স্বার্থপরতা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান। কিন্তু অনাথ শিশু বজলুর জন্য দয়াময় একটি মনের দেখা পাই আমরা। ঔপন্যাসিক তুলে ধরেছেন এভাবে:

‘জয়নালের ঘুম আসছে না। বজলুকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয়াটা ঠিক হয় নি। মনের খচখচানি যাচ্ছে না। শোবার মতো কোনো জায়গা পেল কি-না কে জানে। ছোটখাটো মানুষ, বেশি জায়গার তো দরকার নেই। দু’হাত জায়গা হলেই হয়। এই দু’হাত জায়গাইবা কে কাকে দেয়। এই দুনিয়া খুবই কঠিন। দুই সুতা জায়গাও কেউ কাউকে ছাড়ে না। মায়া-মুহব্বত বলেও কিছু নেই। অবশ্যি মায়া-মুহব্বত না থাকারও কারণ আছে। কেয়ামত এসে যাচ্ছে। কেয়ামত যত নজদিক হয় মায়া-মুহব্বত ততই দূরে চলে যায়। আল্লাহপাক মায়া-মুহব্বত উঠিয়ে নেন। দোষের ভাগী হয় মানুষ। অথচ বেচারা মানুষের কোনো দোষই নেই।’

জয়নাল চরিত্রটা অনেকটা নারকেলের মতো। ওপরে শক্ত হলেও তার ভেতরটা খুবই নরম। নাহলে যার নিজের জীবন চালানো দায় সেই আবার বজলুকে নিজের সঙ্গে রাখে, খাওয়ায়, জীবনে চলার জন্য নানা উপদেশ দেয়। বজলুর আপন চাচা তাকে গৌরীপুর স্টেশনে ফেলে গেছে। বাপ-মা নেই। সংসারে বাড়তি বোঝা কেউই টানতে চায় না। জয়নাল বজলুর প্রতি রূঢ় হয়ে উঠলেও পরক্ষণে কাছে টেনে নেয়।

মালবাবু আর সিগনাল-ম্যান রমজানের সঙ্গে জয়নালের বেশ খাতির। নানান সময়ে তারা জয়নালকে নানানভাবে সাহায্য করেছে।  জয়নাল এ সত্যটা কখনো ভুলতে পারে না। তাদের জন্য কিছু করার চিন্তা সবসময় তাকে ঘিরে থাকে। কিন্তু সে নিজেই অচল তাইতো মালবাবু বা সিগন্যাল-ম্যানের জন্য তার মন পুড়লেও কিছু করার থাকে না। তিন মণ চালের বস্তা পড়ে যখন মরার উপক্রম হয়েছিল তখন মালবাবুই তাকে বাঁচিয়েছে৷ ওষুধের টাকা দেওয়া, খোঁজ নেওয়া সবটাই করেছে। যদিও এই মালবাবুর চরিত্রও দ্বিমুখী। যখন মন ভালো থাকে তখন সে দয়া পরবশ হয় আবার যখন দিন ভালো না যায় তখন খিঁচড়ে ওঠে। কিন্তু সময় ও সুযোগ বুঝে জয়নাল মালবাবুর থেকে চুরি করতেও দ্বিধা করেনি। জয়নালের বিবেকের দংশন প্রতিনিয়তই চোখে পড়ে কিন্তু বেঁচে থাকার তাগিদকে সে উপেক্ষা করতে পারেনি।

জয়নালের চরিত্রে অসদগূণগুলো তার নানা কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পায়। স্টেশনের পুরনো সর্দার মোবারককে নিগৃহীত হতে দেখে আনন্দ পায়। পুলিশকে মোবারকের নাম বলে দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করে। কুলী-গিরি ছাড়ার পর মূলত চুরি করে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নিয়েছে সে। ট্রেনের যাত্রীদের কাছ থেকে চুরি করা ছাড়াও স্টেশনের মালবাবুর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ফেরত দেয় না সে। হুমায়ূন আহমেদ মূলত একজন নিম্নবিত্ত ছিঁচকে চোরের চরিত্র এঁকেছেন যার আছে এক আর্দ্র মন। জয়নালকে আঁকতে গিয়ে ঔপন্যাসিক তুলে ধরেছেন তার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য:

‘জয়নাল তার খোঁড়া পা নিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত এগুতে লাগল । ঠাণ্ডা এবং গরম পানি নিয়ে ফিরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। সে লাইন টপকে বাজারে চলে গেল। জিনিস দুটির জন্যে আশাতীত দাম পাওয়া গেল। দু’শ কুড়ি টাকা। চাপাচাপি করলে আড়াইশ’ পাওয়া যেত। যাক যা পাওয়া গেছে তাইবা মন্দ কি? দু’শ কুড়ি টাকা— খেলা কথা না। হাত এখন একেবারে খালি ।

বাচ্চা দুটোর জন্যে খারাপ লাগছে। আহা অবোধ শিশু। পেটের ক্ষিদেয় কাঁদছে। তবে ওরা কিছু একটা ব্যবস্থা করবেই। তাছাড়া শিশু হচ্ছে ফেরেশতা। আল্লাহতায়ালা নিজেই এদের উপর লক্ষ রাখেন। ক্ষিদের চোটে এরা কিছুক্ষণ কাঁদবে- এরও ভালো দিক আছে। চিৎকার করে কাঁদলে ফুসফুস পরিষ্কার থাকে। ক্ষয়, কাশ, হাঁপানি এইসব কখনো হয় না। সব মন্দ জিনিসের একটা ভালো দিকও আছে।

নিম্নবিত্তের মনোজগৎ নিয়ে পর্যবেক্ষণের উল্লেখযোগ্য উপাদান আছে আলোচ্য উপন্যাসে। মধ্য ও উচ্চবিত্তের চরিত্র নিয়ে জয়নালের দর্শন বেশ চমকপ্রদ। তার ভাষায় ওরা ‘ভদ্রলোক’। আমি মনে করি, ভদ্রলোকদের দয়ার উপরে সর্বদা নির্ভর করছে তার আর্থিক অবস্থা, এটা সে কখনো ভুলতে পারে না বলেই মনে মনে তাদেরকে আক্রমণ করে আনন্দ খুঁজে পায়। কখনো কখনো সামনাসামনি অপমান করেও বেশ শ্লাঘা অনুভব করে জয়নাল। ভদ্রলোক বিপদে  পড়লে জয়নালের বড় ভালো লাগে। তার ভাষায়, ‘ভদ্রলোক বিপদের পড়ে চোখ বড়ো করে যখন এদিক ওদিক চায়,ফটাফট ইংরেজিতে কথা বলে তখন মজাই লাগে’।

জয়নাল, বজলুকে ছাপিয়ে এই উপন্যাসের সবচেয়ে নিপীড়িত-করুণ জীবনযাপন অনুফার। একসময় সাধ্য না থাকলেও মালবাবুর সাহায্য-সহযোগিতায় অনুফাকে ঘরে তোলে জয়নাল৷ কিন্তু তিন মণ চাউলের বস্তা পড়ে যখন কোমর ভেঙে পড়ে থাকে তখন অনুফাও অন্যত্র সুখ খোঁজে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সুখ তার কপালে উঁকিও মারেনি কোনদিন। দুঃখ-কষ্ট- হতভাগ্য নারীর পিছু ছাড়েনি কখনো। নগদ তিনশ টাকা খরচ করে কাজি সাহেব ডেকে যে অনুফাকে বিয়ে করে সুখের মুখ দেখাতে চেয়েছিল সেই সুখের ঘরে বিধাতার অভিশাপে লণ্ডভণ্ড হয় সংসার। জয়নালের ভাষায়:

‘বেশি সুখ কারো কপালে লেখা থাকে না। এটাও আল্লাহতায়ালার বিধান। কাজেই অঘটন ঘটল। চালের বস্তা পড়ে গেল কোমরে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল । কাউকেই সে দোষ দেয় না। সবই কপালের লিখন। কথায় বলে না, কপালের লিখন না যায় খণ্ডন।

তার কপালে লেখাই ছিল কোমরে পড়বে তিন মণ চালের বস্তা, তারপর অনুফা তাকে ছেড়ে চলে যাবে। অনুফার ওপরও তার রাগ নেই। যে স্বামী খেতে-পরতে দেয় না খামাখা তার গলায় ঝুলে থাকবে কেন? তাছাড়া গায়ের রঙ ময়লা হলেও চেহারা-ছবি ভালো। কোনো পুরুষ মানুষ একবার তাকে দেখলে, দ্বিতীয়বার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। সেই পুরুষের চোখ চকচক করে। এই মেয়ের কি দায় পড়েছে জয়নালের সঙ্গে লেপ্টে থাকার? জয়নালের এখন মরে তখন মরে অবস্থা। হাসপাতালে থেকে কিছু হয় নি বলে চলে এসেছে স্টেশনে। একটা পয়সা নেই হাতে। মাথার ভেতরে সব সময় ঝমঝম করে ট্রেন চলে। কিছু মুখে দিলেই বমি করে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে মনে হয় হঠাৎ যেন কেউ সারা গায়ে এক লক্ষ সুচ ফুটিয়ে দিল। সে তখন বিড়বিড় করে বলে- ভাই সকল ধরাধরি কইরা আমারে লাইনের উপরে শুয়াইয়া দেন। আমার জীবনটা শেষ হউক। কেউ তাকে লাইনের উপর শুইয়ে দেয় না বলে জীবন শেষ হয় না। মালবাবুর অফিসের সামনে ময়লা বস্তার উপর সে শুয়ে থাকে । আর ভাবে জীবন জিনিসটা এমন জটিল কেন? ’

জয়নালের জীবন থেকে অনুফার প্রস্থান ঘটলেও তার ভালোবাসায় কোথাও কমতি হয়নি। তাইতো ওজুফা আরও দুই স্বামীর সংসারে গিয়েও যখন সুখী হতে পারেনি এবং শেষমেশ দেহোপজীবিনী হিসেবে কাজে নিযুক্ত হয়েছে তখনও জয়নাল তাকে সমান শ্রদ্ধা করেছে। ভালোবেসেছে দুখিনী নারীটিকে। কারণ জয়নাল জানে জীবনের মানে কঠিন সংগ্রাম। টিকে থাকলে হলে অর্থ প্রয়োজন। কিন্তু সেই অর্থ কেউ দেয় না। তা উপার্জন করতে হয়। অনুফার মতো নারীকে সে অর্থ কেউই দেবে না। পিতৃমাতৃহীন-বিদ্যেহীন-দরিদ্র্য অনুফা তাই অন্যের মনোরঞ্জনের ভার নিয়েছে। তাতেও যখন টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যর্থ হয়েছে তখন সে ঢাকায় গমন করেছে। অনুফার লড়াই,  তার জীবন যাতনা অন্ত্যজশ্রেণির দুঃখ-দারিদ্র্য ও দুর্দশাকে স্মরণ করায়। যারা পেটের তাগিদে, দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার আশায় অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়াতেও দ্বিধা করে না। প্রসঙ্গক্রমে:

জয়নাল বলল, অনুফা নাই?
ও আচ্ছা অনুফা আফা? না উনি এইখানে নাই। হে তো অনেক দিন হইল ঢাকায়- তা ধরেন পাঁচ-ছয় মাস। আসেন না, ভিতরে আসেন। দরজা ধরা মাইনষের সাথে গল্প করতে ভালা লাগে না ।
ঢাকায় গেছে কি জইন্যে?

রোজগারপাতি নাই। কি করব কন? পাঁচ-ছয় জন একলগে গেছে। আমরা ছয়ঘর আছি। আসেন না ভিতরে আসেন। টেকা না থাকলে নাই । চিন-পরিচয় হউক । যেদিন টেকা হইব- দিয়া যাইবেন।

জয়নাল ঘরে ঢুকল। আগের সাজসজ্জায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এই মেয়েটা সম্ভবত শৌখিন। চৌকিতে ফুলতোলা চাদর। ঘরের মেঝে ঝকঝকে-তকতকে । বড় একটা আয়নাও এই মেয়ের আছে । বসেন। দাঁড়ায়ে আছেন ক্যান? চিয়ারে বসেন।

অনুফা, ফুলী, জয়নাল, বজলু, মোবারক, হাশেম এ সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণি। যারা দিন গুজরান করতে চুরি, ডাকাতি, দেহোপজীবিনীর মতো কাজ করে। বিধাতা যাদের সহায় না। তারা মানুষের কাছ থেকেও তেমনই উপেক্ষিত। কিন্তু ক্ষুধার তাড়ানা,  বাঁচার তাগিদ প্রতিটি মানুষের সমান। যার যার অবস্থান থেকে যতটা সম্ভব তাকে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে মানুষ। জয়নাল, বজলু, হাশেম, মোবারকের সৃষ্টি করেছে এ সমাজ। ভাগ্যবিড়ম্বিত এসব মানুষের ভাগ্য ফেরাতে কেউ পথ দেখায়নি। ভালোবাসা তো দূরে থাক সবার চোখ রাঙানি আরও তাদের পথকে ভ্রষ্ট করেছে। ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ এই উপন্যাসে নিজেকে একেবারে অন্যভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।  হাসি-ঠাট্টা- মজার ছলে জীবনকে দেখানোর বদলে তিনি এত গভীরভাবে জীবনের সত্য তুলে ধরেছেন যা সত্যি হুমায়ূন আহমেদকে আরও একবার চিনতে সাহায্য করে। লেখকের প্রজ্ঞা-জ্ঞান ও সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে আরও সুতীব্র করে তোলে।

স্টেশনের নিঃস্ব অসহায় মানুষদের জীবনযাপন ও তাদের চিন্তা-চেতনা কে খুব গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে  ‘গৌরীপুর জংশন’  উপন্যাসটিতে।

জয়নাল এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। তাকে ঘিরেই এর প্লট বিস্তৃত হয়েছে। তার আড়াইশো টাকা চুরি তারপর সেই টাকা দিয়ে তার ইচ্ছে পূরণ পাঠককে এক অন্য জগতে নিয়ে যায়। গৌরীপুর জংশনের কুলি জয়নাল, কুলি সর্দার মোবারক এবং পরবর্তীকালে তাকে হত্যার পর হাশেম, স্টেশন মাস্টার, অসহায় শিশু বজলু, চা বিক্রেতা পরিমলদা, অনুফা, ওসি, ভিক্ষুক সর্বশ্রেণির মানুষকে নিয়ে একটি স্টেশন এবং এই গৌরীপুর স্টেশনেই উপন্যাসের কাঠামো গড়ে উঠেছে। চরিত্রগুলো এত চেনা-পরিচিত হয়েও অধরা।

জয়নালের ভয়ার্ত হৃদয় পাঠককেও এক শঙ্কায় ফেলে দেয়। স্টেশনে কুলির সর্দার মোবারককে খুন করা হাশেম কী শেষপর্যন্ত জয়নালকেও খুন করে ফেলবে?  এই প্রশ্ন বারবারই মনে ধাক্কা দেয়। কারণ হিরণপুর স্টেশনের কাছে মালগাড়ি থেকে দশ বস্তা চিনি চুরির তদন্ত হচ্ছে। এবং তদন্তের ফলে পুলিশ পাঁচ জনকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে মালবাবু একজন। পুলিশ কুলির সর্দার হাশেমকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু সে পলাতক। জয়নাল রমজানের কাছ থেকে যখন ফেরে ঠিক তখনই স্টেশনে হাশেম তার পথ আগলে ধরে। লাইনম্যান রমজান এবং জয়নালের মধ্যে কী কথা হয়েছে তা শোনার জন্য বারবার চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। কিন্তু শেষমেশ কোন সদুত্তর না পেয়ে হাশেম হতাশ হয়। অন্যদিকে জয়নাল তার জীবনের কথা ভাবতে গিয়ে বেদনায় মুষড়ে পড়ে:

জয়নাল হাঁটতে শুরু করে। এত কাছে গৌরীপুর জংশন, তবু মনে হয় অনেক দূর। যেন এই জীবনে সে সেখানে পৌঁছতে পারবে না ।
জয়নালকে ঘিরে একদল পতঙ্গ ওড়াউড়ি করে ।
মানুষ যেমন এদের বুঝতে পারে না, এরাও হয়তো মানুষকে বুঝতে পারে না ।
কে জানে মানুষকে দেখে পতঙ্গরাও বিস্ময় অনুভব করে কি-না?

গৌরীপুর জংশন” উপন্যাসটি লিখিত হয়েছে তৃতীয় পুরুষে। যদিও পুরো কাহিনি এগিয়েছে জয়নালের দৃষ্টিকোণ থেকে। কখনও কখনও তৃতীয় পুরুষ থেকে লাফ দিয়ে প্রথম পুরুষে চলে এসেছেন লেখক। এই রচনাকৌশল ছাড়াও উপন্যাসের ভাষার কাজ পর্যবেক্ষণ করার মতো। হুমায়ূন আহমেদের স্বভাবসুলভ হিউমারে পূর্ণ বর্ণনারীতি তো আছেই, সঙ্গে আছে আঞ্চলিক ভাষার দারুণ সংমিশ্রণ। উপন্যাসটির শেষটা লেখক খুব দ্রুত গতিতে শেষ করেছেন। ছোটগল্পের মতোই অতৃপ্ত থাকতে হয় উপন্যাসটি পাঠ করে। কারণ লেখক হুমায়ূন আহমেদ বরাবরই যত গুছিয়ে গল্প-উপন্যাস-নাটকের প্লট শুরু করেন শেষটাতে ঠিক ততটাই গুটিয়ে নেন নিজেকে। এই উপন্যাসও তার ব্যতিক্রম নয়। জয়নাল, বজলু, হাশেম, মালবাবু, রমজানের ভাগ্য-কর্ম-দণ্ড নির্ধারণ সবই পাঠকের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ