Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বুশরাকে নিয়ে নেটিজেনদের আচরণে বিশিষ্টজনদের শঙ্কা

সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের হিট অফিসার পদে নিয়োগ পেয়েছেন ওই সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামের কন্যা বুশরা আফরিন। এই নিয়োগের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। তার প্রতি নেটিজেনদের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী নারীরা।

ন্যাশনাল হেলথকেয়ার নেটওয়ার্ক (এনএইচএন)-এর যুগ্ম-পরিচালক সায়রা মুন্নী বলেন, ‘পৃথিবীব্যাপী প্রকৃতির নিয়মকানুনের মধ্যে একটা বিশাল পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফল আমরা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি। গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এবং সময় মতো পদক্ষেপ না নিলে আমাদের দেশের মানুষের অস্তিত্ব সংকট দেখা দেবে। ফলে তীব্র তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় মানুষের বিপর্যয় রোধ করার বিষয়ে সাবধান হওয়া প্রয়োজন।’

সায়রা মুন্নী আরও বলেন, ‘অন্যান্য দেশে এ বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করা হলেও বাংলাদেশে এ বিষয়ে পরামর্শ কিংবা কাজ করার কেউ নেই। আমাদের দেশে চিফ হিট অফিসার এই পদটিও নতুন। ফলে এই পদে নিয়োগ দেওয়াকে আমি স্বাগত জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই আমরা নতুন কিছুকে সহজভাবে গ্রহণ করি না।


আমাদের দেশে কিছু মানুষের স্বভাবই হচ্ছে নেতিবাচকভাবে মানুষকে উপস্থাপন করা। আমরা ভালো কাজে সহযোগিতা করি না। বরং কাজটাকে পণ্ড করতে উৎসাহ বোধ করি। কিছু লোকের কাজই হচ্ছে মানুষকে পেছনে টেনে ধরা। কিন্তু এই ‘কিছু লোককে’ অবজ্ঞা করতে হবে। উপেক্ষা করতে হবে। তবেই বিপুল সম্ভাবনাকে আমরা ছুঁতে পারবো।’

এই পেশাজীবী নারী আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশি কোনো নাগরিকের নিয়োগ আমাদের দেশের জন্য গর্বের বিষয় ও আনন্দের। বুশরা আফরিন এই কাজে দক্ষতা দেখিয়ে দেশের জন্য নিশ্চিত সম্মান বয়ে আনবেন।’

লেখক প্রিয়তু শ্যামা বলেন, ‘এশিয়ার প্রথম চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বুশরা আফরিন। খবরটি এখন পুরনো। বহুলচর্চিত একটি বিষয়। বুশরা আফরিনকে নিয়ে চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাবিধ পোস্টমর্টেম। কিন্তু এটা কেন? বুশরা আফরিন একজন সুন্দরী অল্পবয়সী নারী বলে? বুশরা আফরিন পুরুষদের টপকিয়ে একধাপ ওপরে উঠে গেলেন দেখে? আজ যদি বুশরা আফরিন সুন্দরী না হতেন,হতেন মাঝবয়সী কেউ, কিংবা কোনো পুরুষ, তবে কি এই অশ্লীল যৌন-সুড়সুড়ি দেওয়া মন্তব্যগুলো আমাদের চোখে পড়তো? আমি শতভাগ নিশ্চিত যে তা হতোই না।’


শ্যামা আরও বলেন, ‘মন্তব্য করার অনেক যৌক্তিক জায়গা ছিল। হতে পারতো রাজনৈতিক, স্বজনপ্রীতি নিয়ে কঠোর সমালোচনা। সুযোগ ছিল যোগ্যতার সনদ নিয়েও প্রশ্ন তোলা। কিন্তু তা হলে তো পুরুষের স্বরূপটা সবার সামনে অপ্রকাশিতই থেকে যেতো। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত পুরুষের চোখে নারী কেবল একটি ভোগ্যপণ্যই। এছাড়া আর কিছু না। তাই যখনই কোথাও এতটুকু সুযোগ তৈরি হয় পুরুষ সমাজ সেখানেই হামলে পড়ে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বুশরা আফরিনের নিয়োগে কতটা স্বচ্ছতা কিংবা আদৌও কোনো স্বজনপ্রীতি হয়েছে কি না, চাইলে তা নিয়ে ভালোভাবে যাচাইবাছাই করা হোক। কিন্তু তার পোশাক, তার লাইফস্টাইল নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করাটা বন্ধ করা হোক। নারীকে তার যোগ্য সম্মানটুকু অন্তত দেওয়া হোক।’

বরিশাল জেলা সমন্বয়কারী কর্মকর্তা দীপ্তি মণ্ডল দিতি বলেন, ‘একজন মন্তব্য করেছেন ফেসবুকের হিট কমাবেন কোন অফিসার। আরেকজন লিখেছেন যে নিজেই হট সে কি করে হিট কমায়? হট আর হিট শব্দ দুটো কাছাকাছি। তাই সুন্দরী, স্মার্ট একজন নারীর ক্ষেত্রে সহজে ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে কিছু মানুষ তাকে পর্দার দাওয়াত দিয়েছে। একজন মেয়র, নগর পিতার মেয়ের সামাজিক অবস্থা আমরা যারা সাধারণ পরিবারের কন্যা, যারা গার্মেন্টস থেকে শুরু করে উচ্চশ্রেণির কর্মকর্তা, তাদের অবস্থান এই সমাজে কেমন? একটা অসভ্য সমাজের কু-শিক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের। আজকে শুনলাম বুশরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের শিকার হলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই সংগঠনের সঙ্গে কাজ করবেন না। অর্থাৎ তার কাজে ফেরার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।’

দিতি আরও বলেন, ‘যতটুকু জানলাম শহরের তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা মতো অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দেশে চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়। এটা কোনো সরকারি চাকরি নয়। আবার বুশরার বাবার দেওয়া চাকরি নয়। এটা তার অর্জন বলা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন ফলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী ও শিশু। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে উষ্ণ দিনগুলোর সংখ্যা বাড়বে। এতে নারী ও শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে ঢাকা প্রথম দিকে এগিয়ে আছে, বাতাসের সঙ্গে সিসা ভেসে বেড়াচ্ছে। যা মেয়েদের গর্ভনিরোধ করে তুলতে পারে এবং প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নিতে পারে। আমাদের সমাজে শিক্ষিতের হার শতকরায় বেড়েছে কিন্তু মূল্যবোধ, জ্ঞান এবং সমাজিক আচরণ কেউ শিখছে না। একজন মানুষকে বলার জন্য নিদির্ষ্ট সীমা থাকে, ভালো- মন্দের প্রকাশ ভঙ্গি থাকে কিন্তু আমাদের নেই। আমরা প্রতিদিন একটা ছবি আপলোড থেকে প্রতিদিনের পোশাক পরার সময় ভাবি, এটা পরলে আমাকে কেউ কিছু বলবে না তো? আমি কি ঠিক আছি? অথচ একটা পুরুষকে এটা ভাবতে হয় না। হাফ অথবা ফুল জামা, দুভাবেই চলতে পারে। আবার কিছু না পরেও চলতে পারে।’

দীপ্তি মণ্ডল বলেন, ‘বুশরার দোষ অনেক। কারণ তিনি শিক্ষিত, স্মার্ট এবং সুন্দরী। এই সুন্দরী তরুণীকে যৌন ইঙ্গিতবাহী আক্রমণে ভরে উঠছে ফেসবুকের পাতা। যারা এমন মন্তব্য করছে,তারা কারা? তারাই আমাদের সমাজ যেহেতু লিখতে পারে, তার মানে অক্ষরজ্ঞান ছাড়া নয়, তারাও ৭৫% শিক্ষার হারে অন্তর্ভুক্ত শিক্ষিত শ্রেণি। একবার দেখলাম বুশরা এই পদের জন্য কত টাকা বেতন পাবেন, তারও হিসাব চলছে। আসলে তিনি বেতনভুক্ত নয়। শুধু বুশরা নন, আমরা অনেক বুশরাকে চিনি, যাদের বাবা দিনমজুর তারা অর্থনীতির হাল ধরতে পারেন না; শুধু মানুষের মন্তব্যের কারণে। আবার অনেকে সকল মন্তব্য পায়ের নিচে পিষে ঠিক নিজের পথে এগিয়ে চলছেন। নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি আসলে কি সম্ভব, এই ঘূনে ধরা সমাজে? সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতারক, অশুভ সংকেত আর মন্তব্যের ভেতরে একজন মেয়ে কত দিন যুদ্ধ করতে পারে। তবু স্বাগত জানাই সেই সব নারীকে, যারা কাউকে তোয়াক্কা না করে নিজের কর্মটাকে বেছে নিতে পেরেছেন। সরকারি কর্তৃপক্ষের এখনই উচিত, ফেসবুকের লাগাম টেনে ধরার এবং কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা করার।’

ব্যাংক কর্মকর্তা ইসরাত জাহান দিপা বলেন, ‘একজন মানুষের পরিচয় তার কর্মে, সে নারী হোক আর পুরুষ হোক। বিশ্বায়নের তুমুল প্রতিযোগিতায় আমরা যেন হিংসা,বৈরিতা আর পরশ্রীকাতরতায় দারুন ব্যস্ত সময় পার করছি। গত বুধবার থেকে সারাদেশজুড়ে যেন একটা পদ নিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের (আর্শট-রক) সঙ্গে ঢাকার তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টায় যৌথভাবে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। চলতি বছরে ঢাকার তাপমাত্রা ছাড়িয়ে গেছ ৪০ডিগ্রির ওপরে। ৫৮ বছরের মধ্যে এটি ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। বাংলাদেশকে প্রায় প্রতিবছরই এমন তাপপ্রবাহের কবলে পড়তে হচ্ছে। এমনই এক সংকটের মধ্যে গত বুধবার বুশরা আফরিন ‘চিফ হিট অফিসার’-এর দায়িত্ব পেয়েছেন। এশিয়ায় প্রথম চিফ হিট অফিসারও তিনি। আমদের দেশের অধিকাংশ ব্যক্তিই ওই পদ সম্পর্কে বলতে গেলে অনভিজ্ঞ। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এই পদ ও পদে নিয়োগপ্রাপ্ত বুশরা আফরিনকে নিয়ে নানা কটূক্তি ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য প্রকাশ করছে।’

দিপা আরও বলেন, ‘মানুষের যোগ্যতাকে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তিগত পরিচয়কে তুলে ধরে একজন নারীর প্রতি এত অবমাননা সত্যিই দুঃখজনক ঘটনা। কানাডায় গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে পড়াশোনা করেছেন বুশরা। এছাড়া বাংলাদেশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা শক্তি ফাউন্ডেশনেও আধিকারিক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। অথচ পারিবারিক পরিচয়কেই আমাদের গণমাধ্যম হাইলাইট করছে। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো পত্রিকা তার ব্যক্তিগত ছবিতে নোংরাভাবে প্রকাশ করছে। এগুলো ব্যক্তিগত আক্রোশ ছাড়া অন্য কিছু নয়। খুবই মর্মাহত হতে হয়, যখন দেখি নারীর প্রতি সম্মান কিংবা তার প্রাপ্তি নিয়ে কটাক্ষ করা হয়। অথচ বিশ্বের আরও বড় বড় শহরে এই একই পদ সৃষ্টি হয়েছে আরও আগে। ঢাকা ছাড়াও বিশ্বের আরও ছয়টি শহরে ‘চিফ হিট অফিসার’ রয়েছেন। এগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি, চিলির সান্তিয়াগো, সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউন, গ্রিসের এথেন্স ও অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। এসব শহরের হিট অফিসাররা সবাই নারী। আমার মনে হয় না এসব যোগ্য নারীকে নিয়ে তাদের সমাজ এমন অসৌজন্যমূলক আচরণ করে।’

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ