Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সমরেশ বসুর পাড়ি গল্পে নারীর জীবনসংগ্রাম

সমরেশ বসু (১১ ডিসেম্বর ১৯২৪-১২ মার্চ ১৯৮৮) খ্যাতিমান বাঙালি গল্পকার, ঔপন্যাসিক। তিনি মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন-যন্ত্রণা, সংগ্রামকে খুব কাছ থেকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই যে কত কঠিন তাঁর বিভিন্ন গল্পে সে বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সমাজে বসবাসকারী মানুষদের বাইরের মুখোশ এবং ভণ্ডামির আবরণকে তুলে ধরেছেন। বাঙালি উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের জীবন ঘুরেফিরে তাঁর গল্প, উপন্যাসের উপাদান হয়েছে। গ্রামবাংলার লোকায়ত মানুষ শোষিত হয় উচ্চবিত্তের দ্বারা। তবু একটু বাঁচার তাগিদে, দুবেলা দুমুঠো ভাত জোটানোর জন্য নীরবে নিভৃতে সব সহ্য করে চলে এ শ্রেণি।

যাদের মাথার ওপর ছাদ নেই, পেটে ভাত নেই, লজ্জা নিবারণের এক টুকরো কাপড় নেই সেই দুর্ভাগ্য পীড়িত, অসহায়, অবলা পশুর মতো মানুষ সমরেশ বসুর গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে। যাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা, ব্যর্থতার হাহাকার, স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা, মানুষ হিসেবে পরিপূর্ণ বিকাশের অভাব, জীবনকে বাজি লাগিয়ে টিকে থাকার লড়াই সবই প্রাধান্য পেয়েছে।

সমাজের নিচুতলার মানুষের বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম উঠে এসেছে তাঁর ‘পাড়ি’ নামক ছোটগল্পে। গল্পে প্রবেশ করে ভেতরে একটা বুকচাপা কান্না বলক দিয়ে ওঠে। মনে হয় গল্পের পাত্র-পাত্রীর সঙ্গে গভীর বেদনায় পাঠকও নিমজ্জিত হন। হৃদয়ভার হয়ে ওঠে। চেতনায় শৈথিল্য আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামার পর দুর্ভিক্ষ পীড়িত দেশে নিম্ন শ্রেণির জীবন আরও কতটা শোষিত হতে থাকে তা এ গল্প পাঠে উপলব্ধি করা যায়। একদিকে সমাজে নিম্নশ্রেণির মানুষের অভাব, অভিযোগ, অসহায়তা, ক্ষুধার জ্বালা অন্যদিকে উচ্চবিত্তের শোষণ-নিপীড়ন।

দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন্য পেটের ক্ষুধা নিবৃত্ত করে বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ জীবন বাজি রাখতেও পিছুপা হয় না এই গল্পটি তার প্রমাণ। গল্পের পাত্র-পাত্রী নতুন বিবাহিত দম্পতি। বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামের এক নট জাতীয় দম্পতি। সামান্য খেয়ে পরে বেঁচে থাকার তাগিদে সূদুর বিহার থেকে তারা ঝাড়ুদারের কাজ করতে আসে। তাদের গ্রামের ননকু হলো ঝাড়ুদারের সর্দার। তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে গ্রাম ছাড়ে এ দম্পতি। যদিও গ্রামেই তাদের অত্যন্ত দুটি ভাত জুটে যেত। কিন্তু ঝাড়ুর কাজ করলে দুজনে মিলে ষাট টাকা রোজকার হবে সেই আশ্বাস পেয়ে গ্রাম ছাড়ে। কিন্তু গ্রাম ছেড়ে এসে প্রথমদিকে দুজনে মাত্র বত্রিশ টাকা রোজকার করে। দেড় মাস সাফাই কাজ করার পর মিউনিসিপালিটির দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

খাবার নেই। শুধু বস্তিতে কোনরকমে মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই হয়। কিন্তু এই অসহায় নট দম্পতির কাজ না থাকার অর্থ হলো তাদের পেটে খাবার না জোটে। দিন সাতেক বস্তির মানুষগুলো তাদের খাবার জোগালেও আজ দুদিন তাদের পেটে একটু দানাও পড়েনি। শেষপর্যন্ত কাজ পায় গঙ্গার ওধারে শুয়োরের দলকে নিয়ে যেতে হবে। ঠিক হলো উনত্রিশটি জানোয়ারের জন্য উনত্রিশ আনা মজুরি। উপরি পাওনা হিসেবে পাবে গায়ে মাখার কিঞ্চিৎ তেল। অন্যদিকে একটি শুয়োর খোয়া গেলে ছয় মাসের হাজত বাস। পয়সা বাঁচানোর জন্য ব্যবসায়ীটি মাত্র দুটি মানুষকে দিয়ে এত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করাতে স্থির হয়। কিন্তু নট দম্পতির পেটের ক্ষুধার জ্বালা তাদের এত বাছবিচার করলে চলবে না। তাই খোরস্রোতা গঙ্গার স্রোতে শুয়োর নিয়ে যেতেই হবে। যতক্ষণ তারা গন্তব্যে না পৌঁছাতে পারবে ততক্ষণে তাদের দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষুধা সহয় করতে হবে। পেটে ক্ষিদের জ্বালা নিয়ে তারা মনে মনে বলে, ‘হ্যাঁ আমরা ভুখা। সেইজন্য আমাদের পার হতে দাও। সোনার মাকড়িটা কারবারি। ও আষাঢ় মাসের জানোয়ার পার করাচ্ছে বিনা নৌকায়। উনত্রিশটা জানোয়ার আরে বাপ! দুটো মানুষ!’

এই গল্পে নট দম্পতির জীবন সংগ্রাম সাধারণ নিম্নবর্গের জীবনচিত্রকে প্রতিফলিত করেছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ তাদের সমস্যা, প্রতিকূলতাকে জয় করতে সাহস ও সক্ষমতা জুগিয়েছে।

এরপর শুরু হয় ওদের কঠিন সংগ্রাম। আষাঢ়ের গঙ্গা, অম্বুবাচির পর ঢল নেমেছে বুকে, যেন মেয়ে গঙ্গা মা হয়েছে। আছড়ে আছড়ে পড়ছে। ফুলছে কাঁপছে যেন আর ধরে রাখতে পারছে না নিজেকে। স্রোতও সর্পিল হচ্ছে। যুবক-যুবতী দুজনেই গঙ্গা দিয়েই পশুগুলোকে ওপারে নিয়ে যাওয়ার কাজে হাত দিয়েছে। পার করার সময়েই সামনে এল বড় ঘূর্ণি। এমনভাবে ঘূর্ণি এলো যেন মানুষ, পশু সব খেয়ে ফেলবে। কিন্তু তাদের পেটের ক্ষুধাও দ্বিগুণ। পানির স্রোতে চোখ লাল। থমকে থমকে যাচ্ছে স্রোত। মেয়েটি মেয়ে মানুষ তাই তার মনে নানান প্রশ্ন। স্বামীকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করছে তাদের এই ঝুঁকির কাজ কম মূল্যে নেওয়া পড়েছে। পাড়ি দিতে হবে গঙ্গার স্রোতে কিন্তু নূন্যতম পারিশ্রমিক তাদের। একটি নৌকাও নেই। কিন্তু পেটের জ্বালাতে তো এত হিসাব-নিকাশ করলে চলে না। পুরুষটি ঘূর্ণির কাছাকাছি চলে গেলো পশুগুলোকে বাঁচানোর জন্য। মেয়েটি মরিয়া হয়ে উঠেছে তার পুরুষকে বাঁচাবার জন্য। সে চাইছে তার কাছে যেতে কিন্তু পারছে না। মেয়েটির পরনের কাপড় ছিনিয়ে নিয়েছে ঘূর্ণি। এত প্রতিকূলতা, জীবন মৃত্যুর হানছানিতে তাদের পেটের ক্ষুধা কখন মিইয়ে গেছে। প্রাণ যাওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে উঠলেও অবলা পশুগুলোর নিরাপত্তার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। স্রোতের মুখ থেকে শুয়োরগুলোকে সামনের দিকে নিতে চেষ্টা করে। এরমধ্যে তাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথা আী মনেই আসে না। ‘ক্ষুধার কথা ভুলে গেছে দুজনেই। অনেকক্ষণ ভুলে গেছে। পার হতে হবে শুয়োরগুলোকে নিয়ে, সেইটেই একমাত্র কথা, একমাত্র ভাবনা।’

আকাশ ভেঙে আসছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সজোরে। পশুগুলো ভীত হয়ে এলোমেলো চলা শুরু করেছে। রাত্রিও গভীর হচ্ছে, অন্ধকার বাড়ছে। আকাশের ব্রজপাতের শব্দ কমলে জলের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ভয়ংকর হচ্ছে পরিবেশ ক্রমাগতই। তবু তাদের পৌঁছাতে হবে গন্তব্যে। অবশেষে সব প্রতিকূলতা জয় করে তারা পাড়ে পৌঁছাতে পারে। খাবার পায়। মেয়েটির চোখে জল। তার লজ্জা নিবারণের ছোট এক টুকরো কাপড় জলের স্রোত টেনে নিয়ে পালিয়েছে। তার সঙ্গী পুরুষ তাকে সান্ত্বনা দেয়। সোহাগ করে। ‘তারপরে দুজনে রক্তে রক্তে যোগ করে অনুভব করতে লাগল বাঁচাটা।’

লেখক সমরেশ বসু মানুষের জীবনের দুটি প্রবৃত্তিকে একই সূত্রে গাঁথতে সক্ষম হয়েছেন। মানব জীবনের প্রধানতম চাহিদা পেটের ক্ষুধা এবং শরীরের ক্ষুধা। এই ক্ষুধার নিবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনের অনেকটা পাওয়া হয়ে যায়। নিম্নবর্গের এসব মানুষের জীবনের প্রধান চাহিদা দুবেলা দুমুঠো ভাত। সঙ্গীর ছোঁয়া। এর বাইরে অধিকার তাদের নেই। তাই দেখা যায় পেটের এবং দেহের ক্ষিদে মিটিয়ে পুরুষটি একসময় গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশ বিভাগ, স্বাধীনতার অব্যবহিতকালে একশ্রেণির শোষণ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে ওঠে একশ্রেণি। সাধারণ নিম্নবর্গের মানুষকে প্রতিনিয়ত শোষণ করে টাকার পাহাড় গড়ে তোলে। সর্বহারা নিপীড়িত শ্রেণির কথায় এখানে উঠে এসেছে। অর্থনৈতিক সংকট মানুষের জীবনকে কতটা নিচে নামিয়ে আনতে পারে তার সার্থক একটি গল্প। শুধু ক্ষুধা নিবৃত্ত করার জন্য ক্ষুরধার গঙ্গার মাইলকে মাইল স্রোত ঠেলে পশুকে পাড়ি দিয়ে পৌঁছে দেয় গন্তব্যে। নট দম্পতির মধ্যে ক্ষুধার জ্বালা থাকলেও ভালোবাসার ঘাটতি নেই। স্বামীর কথাকে শিরোধার্য করে মেয়েটিও সঙ্গী হয়েছে তার। কোমল, নমনীয় ভালোবাসায় আগলে রাখতে চেয়েছে প্রিয়তম মানুষটিকে। দুরন্ত প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুজন ক্ষুধিত মানুষ কিভাবে নিজেদের দুঃখকে জয় করতে সক্ষম হয়েছে, একটু খাবারের আশায় কিভাবে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে তার পরিপূর্ণ রূপায়ন এ গল্পটি।

সমরেশ বসুর গল্পে মার্কসবাদী চিন্তা, চেতনা দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। উচ্চশ্রেণি কর্তৃক নিম্নবর্গের প্রতি দয়ামায়াহীন রুঢ় বাস্তবতা প্রকাশিত হয়েছে এ গল্পে। সমরেশ বসুর সমাজ সচেতনতা ও সমাজ মনস্কতা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবন সংগ্রাম, পাওয়া না পাওয়ার চিত্র অভিজ্ঞতার আলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই গল্পে নট দম্পতির জীবন সংগ্রাম সাধারণ নিম্নবর্গের জীবনচিত্রকে প্রতিফলিত করেছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ তাদের সমস্যা, প্রতিকূলতাকে জয় করতে সাহস ও সক্ষমতা জুগিয়েছে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ