যৌন হয়রানি, রুখতে হবে নিজেকেই
যৌন হয়রানির বিষয়টি যেন আজকাল নিত্যদিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে। ঘর থেকে বের হওয়া মানেই হয়রানির আশঙ্কায় থাকতে হবে। শুধু কি ঘরের বাইরে? ঘরের ভেতরের পরিবেশও নারীর জন্য নিরাপদ নয়। কিন্তু এসব বিষয় সমাজে এতটাই শেকড় গেড়ে বসেছে যে, নিত্যদিনের যৌন-হয়রানি দেখেও দেখছে না প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টরা।
নিত্যদিনের যৌন-হয়রানি রুখতে দায়িত্ব নিতে হবে নিজেকেই। ভরসা রাখতে হবে আত্মবিশ্বাসের ওপর, যেকোনো পরিস্থিতিতে রুখে দাঁড়াতে শিখতে হবে। সমাজ যৌন-হয়রানিকে স্বাভাবিক বিষয় তৈরি করে ফেললেও বিষয়টি যে একদমই স্বাভাবিক নয় তা বুঝতে হবে নারীকে। এ কাজও নেহাত এত সহজ নয়। কারণ সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের মস্তিষ্কে এমনভাবে কিছু ধারণা গেঁথে আছে যেমন, ‘মেয়ে মানুষ বাসে উঠলে ধাক্কা তো খেতেই হবে, রাতের বেলায় বাইরে বেরোলে দু-চারটে কথা তো শুনতে হবেই, বসের সঙ্গে তাল না মেলালে প্রমোশন হবে নাকি!’
এমন আরও বহু জটিল, অপরাধমূলক বিষয়কে সমাজ আজকাল সহজ করে দিয়েছে। খবরের কাগজের পাতা থেকে শুরু করে ফেসবুকের পাতায় চোখ বুলালেই দেখা যাবে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। একদম প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে রাজধানী অথবা বড় বড় শহরগুলোতেও এখন ঘটছে নারী নির্যাতন এবং নারী লাঞ্ছনা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানির মতো ঘৃণ্য ঘটনাগুলো। নারীরাও প্রতিবাদ না করে মানতে শুরু করে দিয়েছে যে তাদের যৌন হয়রানি মুখ বুজে সহ্য করতে হবে।
তাই প্রাথমিক পরিবর্তন আনতে হবে নারীর মানসিকতায়। নারীকে বুঝতে হবে যৌন হয়রানি আসলে কি, কখন তিনি যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। নারীর নিজের ভেতর আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে হবে যে তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে তার সাথে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারেন। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশাসন যেখানে মুখ ফিরিয়ে নেয় সেখানে তার লড়াই লড়তে হবে তাকে একাই।
এইতো বেশ কয়েকদিন আগের ঘটনা। পাবলিক বাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে এক কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী একাই প্রতিবাদ করেন অপরাধীর বিরুদ্ধে। তার একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমজুড়ে। তার নাম আসে গণমাধ্যমেও। বাসে একা একটি মেয়ে প্রতিবাদ করছে, আর পুরো বাসভর্তি মানুষ তাকিয়ে দেখছে। তবুও দমে যাওয়ার পাত্রী নন প্রতিবাদী সেই মেয়ে। একাই আওয়াজ তুলে যাচ্ছেন তার সাথে ঘটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ২৪ সেকেন্ডের এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল।
বাংলাদেশে যৌন হয়রানি বৃদ্ধির প্রধান কারণ বলা যায় নারীর পরনির্ভরশীলতা, নারীর যৌন শিক্ষার অভাব ও নারীর দুর্বল মনোভাবকে। আমাদের দেশে যৌনশিক্ষার প্রচলন নেই বললেই চলে। যৌনশিক্ষা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা না হওয়ার কারণে এ বিষয় গুলো একধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে।
মূল ঘটনা ছিলো, মেয়েটির পাশের সিটে বসা লোকটি কয়েকবার তার গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করে। মেয়েটি তাকে বেশ কয়েকবার সতর্ক করার চেষ্টা করলেও, প্রত্যেকবার লোকটি বোঝানোর চেষ্টা করে বিষয়টি ভুলবশত হচ্ছে। এক সময় মেয়েটি মাথা ব্যথার কারণে চোখ বন্ধ করে জানালার সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে বসে। লোকটি ভাবে সে ঘুমিয়ে পরেছে আর এই সুযোগে আবারও তার গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করে। তখনই সেই মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে। পুরো বাসভর্তি মানুষ থাকলেও তার জন্য কৌতুহলবশতও এগিয়ে আসেননি কেউ।
এই ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়, অনেকে তাকে বাহবা জানায় তবে এক শ্রেণির লোক বরাবরের মতোই প্রশ্ন তোলেন মেয়েটির চরিত্র নিয়ে, পোশাক নিয়ে, পরিবার নিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায় বিভিন্ন ধরণের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য। গতানুগতিক ধারায় ভিকটিম ব্লেমিং এর শিকার তিনি। মূলত এই জায়গাটিতেই আটকে আছে আমাদের দেশ। ভিকটিম ব্লেমিং এমন পর্যায়ে আছে যে ভিকটিম আত্মহত্যা কিংবা ঘরের কোনে মুখ লুকোনোর পথ বেছে নেন।
বাংলাদেশে যৌন হয়রানি বৃদ্ধির প্রধান কারণ বলা যায় নারীর পরনির্ভরশীলতা, নারীর যৌন শিক্ষার অভাব ও নারীর দুর্বল মনোভাবকে। আমাদের দেশে যৌনশিক্ষার প্রচলন নেই বললেই চলে। যৌনশিক্ষা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা না হওয়ার কারণে এ বিষয় গুলো একধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। যেমন, যৌন হয়রানি রুখতে হলে আগে বুঝতে হবে যৌন হয়রানি আসলে কি।
এরপর যদি বলি পরনির্ভরশীলতার কথা, সমাজের বেশিরভাগ পুরুষ যারা কোনো না কোনোভাবে নারীকে হয়রানির মনোভাব নিয়ে তৈরি থাকে। তাদের ধারনা একা নারী কি করবে, নারীরা অপরের তথা পুরুষের উপরে অনেকাংশেই নির্ভরশীল, যার কারণে বেশির ভাগ নারীরা একা চলাফেরাও করতে পারেনা৷ আর এই বিষটিকেই নারীর দুর্বলতা ভেবে বসে অপরাধীরা।
তবে দিনশেষে বলতে হবে নারীর মনোভাবের কথা। আমাদের দেশের নারীরা মানসিকভাবে অনেকটাই দুর্বল। প্রতিবাদের পরিবর্তে আত্মহত্যাকেই শ্রেয় মনে করেন অনেক নারী। পরিবার ও সমাজের চোখ রাঙানোর ভয়ে মুখ বুজে সহ্য করাকেই শ্রেয় মনে করেন নারীরা। কিন্তু যেখানে প্রশাসনও নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে, রাষ্ট্রের চোখে কালো কাপড় বাধা, সেখানে দায়িত্ব তো নিতে হবে নিজেকেই। নিজের প্রতিবাদের মাধ্যমেই রুখতে হবে যৌন হয়রানি।
যে সমাজে আজও কন্যা সম্তান জন্মালে কালো মেঘের ছায়া দেখা যায় পরিবারের সদস্যদের চোখেমুখে, যেখানে আজও নারীশিক্ষাকে বিলাসিতা মনে করা হয়, যেখানে রাত ৯ টার পর নারীর ঘরের বাইরে বের হওয়াকে অপরাধ মনে করা হয়, যেখানে ধর্ষণের ঘটনায় নারীর পোশাককে দায়ী করা হয়, যেখানে প্রশাসনের নাকের ডগায় ধর্ষক ঘুরে বেড়ালেও কাঁদা ছোড়া হয় ভিকটিমের দিকে সে সমাজে নিজে প্রতিবাদী না হলে বাঁচা দায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাই দিনশেষে নারীকে শিখতে হবে নিজের জন্য প্রতিবাদ করা, লড়াই করা।