বিয়ে নারীকে কিসের নিশ্চয়তা দেয়?
দেশে নারীশিক্ষার হার যত বাড়ছে, তত আত্মনির্ভরশীলতা বাড়ছে না বলে মনে করেন সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী নারী। তাদের মতে, সমাজ এখনো একা নারীকে অসহায় ভাবে। তার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। সমাজ মনে করে নারী মাত্রই পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। তাই তাকে শৈশবে বাবার ঘরে, যৌবনে স্বামীর ঘরেই আশ্রয় নিতে হবে। অর্থাৎ বিয়ের মাধ্যমে তাকে তার আশ্রয় খুঁজতে হবে। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের এই মনোভাব নারীর জন্য অমর্যাদাজনক ও অসম্মানের বলেও মনে করেন তারা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বাংলার সহযোগী অধ্যাপক মনোরমা ইসলাম বলেন, ‘আমার কাছে বিয়ে মানে শুধু একটি সামাজিক প্রথা নয়, এটি মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ও। কারণ, বিয়ের মাধ্যমে যেমন সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় থাকে তেমন একজন মানুষের শরীর ও মনের আশ্রয় নিশ্চিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমরা বিয়ে মানে শুধু ২ মেরুর ২ জন নিয়ম মেনে এক ছাদের নিচে বসবাস করা বুঝি।’ তিনি বলেন, ‘যেখানে শুধু একের পর এক দায়িত্বের বোঝা নিয়ে দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর, বছর থেকে যুগ পার করাটাই মুখ্য হয়ে যায়। আমাদের দোষ নেই, এটাই আমাদের শেখানো হয়েছে কিংবা আমরা ছোট থেকে এটাই দেখছি।’
রাবির এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘আশার কথা হলো, এখন দিন বদলে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে প্রত্যেকেই নিজেকে স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখেছে, বর্তমানে এই ভাবনার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। অনেকে এর অপপ্রয়োগ করে অধিকার, দায়িত্ব, কর্তব্য ও ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিধি অতিক্রম করে তালগোল পাকিয়ে ফেলে, সেটা ভিন্ন বিতর্ক।’ তিনি বলেন, ‘যারা এই প্রতিটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে সামাজিক নানা ট্যাবুকে উপেক্ষা করে শুধু শরীরের পাশাপাশি মনকে প্রাধান্য দেয়, তারাই আসলে বিয়ের মূল উদ্দেশ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে।’
মনোরমা ইসলাম বলেন, ‘ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও জীবনযাপনের মাত্রাতিরিক্ত চাহিদার ফলে সৃষ্ট যান্ত্রিক মনোভাব বা অর্থনৈতিক বিলাসিতার অসুস্থ প্রতিযোগিতাও আমাদের দাম্পত্য, পারিবারিক, সামাজিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে প্রতিটি বিষয়ই কিন্তু একজন মানুষের মানসিকতাকে অস্থিরতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। যা তার আশেপাশের প্রতিটি মানুষের ওপর প্রভাব ফেলছে। তাই বিয়ে মানেই কি মেনে নেওয়া? না কি মানিয়ে নেওয়া?’ তিনি বলেন, ‘এটি প্রতিটি মানুষের মানসিক পরিপক্বতা, পারিবারিক শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করছে। কেউ মানিয়ে নিচ্ছেন, কেউ চাপিয়ে দিচ্ছেন। আমার মতে, বিয়ে মানে নিজেকে আবিষ্কার করা। আপনি কতটা পরিপক্ব, কতটা মানবিক, কতটা সামাজিক, কতটা দায়িত্বশীল, কতটা আত্মসচেতন। এসব কিছুর পর্যাপ্ত উপস্থিতিই একজন মানুষকে পরিপূর্ণ ও সচেতন করে তোলে।’
এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘একজন সচেতন মানুষ কখনোই কোনো অনুচিত কিছু মেনে নেবেন না। কাউকে মানতেও বাধ্য করবেন না। মেনে নেওয়া কিংবা মানিয়ে চলা কোনো সুস্থ সম্পর্কের সূচক নয়। সুতরাং, বিয়ে মানে অবশ্যই মেনে নেওয়া বা মানিয়ে চলা নয়। বিয়ে মানে একটি সম্পর্কের মধ্যে থেকে একে অন্যের যত্ন করা এবং সম্পর্ককে দীর্ঘস্থায়ী করা।’
সংবাদকর্মী ফাতিমা মারজান বলেন, ‘‘কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘লোকে ভুলে যায় দাম্পত্যটা একটা আর্ট, প্রতিদিন ওকে নতুন করে সৃষ্টি করা চাই।’ সেই তিনিই আবার লিখেছেন, ‘বিয়ে করলে মানুষকে মেনে নিতে হয়, তখন আর গড়ে নেবার ফাঁক পাওয়া যায় না।’ তাহলে বিয়ে মানেই কি দুজনের মানিয়ে নেওয়া শুধু! কথাটা পুরোপুরি বাস্তবতার সঙ্গে না মিললেও অনেকাংশে সত্য। সফল দাম্পত্য তথা বিয়ের সাফল্য লুকিয়ে আছে পারস্পরিক বোঝাপড়া, ভালোবাসা, বিশ্বাস ও আনুগত্যের মধ্যে। যেকোনো একটির ঘাটতি ডেকে নিয়ে আসতে পারে কলহ-বিবাদ। তা থেকে হতে পারে সম্পর্কের অবনতি।’’
ফাতিমা মারজান আরও বলেন, ‘পারস্পরিক বোঝাপড়ার মূল শর্তই একে অন্যের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, মানিয়ে চলা। জীবন সঙ্গীর সব কর্মকাণ্ড বা চালচলনই যে ভালো লাগবে, তা তো সম্ভব নয়। তাই বলে দাম্পত্য কলহ, বিবাদের মাধ্যমে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ কোনো সমাধান হতে পারে না। মানিয়ে নেওয়া ও চলার মধ্যে বিয়ের প্রকৃত সফলতা নিহিত রয়েছে। সেইসঙ্গে সুস্থ দাম্পত্য জীবন, বিশ্বাস ও আনুগত্য বিয়েকে করবে আপন মহিমায় প্রস্ফুটিত। ’
লেখক, গবেষক ও ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক পূজা মিত্র বলেন, ‘বিয়ে মানে সবকিছু মেনে নেওয়া নয়। হতে পারে কিছুটা মানিয়ে নেওয়া। কিন্তু তা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রে। নতুন জীবনে, নতুন পরিবেশে, নতুন মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাটা খারাপ কিছু নয়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, একটি মেয়েকেই কেবল বিয়ের পরে নতুন সংসারে গিয়ে সবকিছু মেনে নিতে হবে। আমাদের সমাজ সংবিধান রচনা করে রেখেছে যে, মেয়েরা যেহেতু বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি যায়, তাই তাদেরই সবকিছু মেনে নিতে হবে। যে মেয়ে নিজের পূর্বজীবন তথা পূর্বপরিচয়, অভ্যাস; এমনকি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ভুলে স্বামীর সংসারের সঙ্গে একাত্ম হতে পারে, সেই মেয়ে লক্ষ্মী বউ।’
পূজা মিত্র বলেন, ‘শ্বশুরবাড়ির লোকজন পারলে নারীর আগের নামও বদলে দেয়। মেয়েদের ছোটবেলা থেকে শেখানো হয় শ্বশুরঘরই তার আপনঘর। সেখানে গিয়ে যেন তারা মানিয়ে নিতে পারে অগ্রিম সেই শিক্ষাও দেওয়া হয়। আদর আহ্লাদে বড় হওয়া একটি মেয়ের বিয়ে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় মানিয়ে চলার,মেনে চলার জীবন। যা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর থামে না। এই যে মেনে নেওয়া এর মানেই হলো বীভৎস পুরুষতন্ত্রকে স্বীকার করা। সতীসাধ্বী,লক্ষ্মীমন্ত বউ ইত্যাদি উপাধি পাওয়ার লোভে নারীও মেনে নেয়। এই মেনে নেওয়ার জীবনের আরেক নাম ভয়ঙ্কর দাসত্ব।’
এই লেখক আরও বলেন, ‘আমাদের সমাজে যেহেতু নারীকে বিয়ের পরে স্বামীর ঘরে অবস্থান করতে হয়, তাই ভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে খাপ তাদের খাওয়াতে হয়। কিন্তু এর মানে এই নয়, নিজের স্বাতন্ত্র্যকে বিসর্জন দিতে হবে। তার মানে এই নয় যে, যাকে অন্যায্য মনে হয়, তাও মেনে নিতে হবে। শুধু আদর্শ স্ত্রী কিংবা পুত্রবধূ হওয়ার জন্য নারীর জন্ম নয়, নারী একজন পরিপূর্ণ আদর্শ মানুষও বটে। আর একজন আদর্শ মানুষের থাকে পূর্ণ আত্মসম্মানবোধ। কেবল মেনে আর মানিয়ে চললে আত্মমর্যাদা অটুট থাকে না। তাই নারীকে হতে হবে দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন। এর অর্থ কিন্তু অবাধ্যতা কিংবা উচ্ছৃঙ্খলতা নয়।’
পূজা মিত্র বলেন, ‘বিয়ের পরে মানিয়ে যদি নিতে হয়; নারী-পুরুষ উভয়েই নেবে, যদি কিছু মেনে নিতে হয় তাহলে উভয়ে মানবে। বিয়ের পরে নারীকেই কেবল সবকিছু মেনে, মানিয়ে চলতে হবে; এই একচক্ষু ধারণা কোনো সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারে না।
মূলকথা হলো, বিয়ের পরে নারীকেই কেবল সব মেনে নিতে হবে। এটা ভীষণ অন্যায্য একটি ধারণা। সমাজ থেকে এই ধরণার অবসান হওয়া জরুরি। ’
কথাসাহিত্যিক সাফিনাজ সুলতানা বলেন, ‘বিয়ে মানে সবকিছু মেনে নেওয়া নয়। বিয়ের সঙ্গে সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। একজন নারীর সবসময় ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক নিয়ে কথা বলার অধিকার আছে। সেটা বিয়ের পর বদলে যেতে পারে না। হ্যাঁ বিয়ের পর অন্য একটা পরিবারে গেয়ে নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার একটা ব্যাপার থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাই বলে সেটা নারী যে মূল্যবোধ নিয়ে বড় হয়েছে, তার সঙ্গে আপস করা নয়। সেটা একজন নারীকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি যদি তার জায়গায় দৃঢ় থাকেন যে তিনি যা করছেন, সেটা সবার জন্য ভালো , তাহলে তা স্টাবলিশড করার ক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
এই কথাসাহিত্যক বলেন, ‘বিয়ের পর কোনো পারিবারিক চাপে পড়ে এমন কোনো কিছুকে যদি তাকে মেনে নিতে হয়, তাহলে তা দুঃখজনক। এক্ষেত্রে পরিবারের সবারই ভালোটাকে মেনে নেওয়ার মতো সহনশীলতা থাকতে হবে। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। দেখুন, যেটা স্বাভাবিক, যেটা দশ জনের কাছে গ্রহণযোগ্য, সেটাই টিকে যাওয়া উচিত। বিয়ের পর কোনো নারীকে তার ব্যক্তিত্ব থেকে সরে আসার কোনো কারণ দেখি না। কোনো চাপের মুখে মন্দকে মেনে নেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এক্ষেত্রে একজন নারীকেই বাধাগুলো পেরিয়ে যেতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বিয়েটাকে যদি আমরা নারীদের বেঁচে থাকার বা জীবন চালানোর অবলম্বন হিসেবে দেখি, তখন নারী দৃঢ় গলায় কথা বলতে পারবে না। সব মেনে নিতে হবে। সেটা কাম্য হতে পারে না। নারী যে অবস্থানেই থাকুক না কেন, দিন শেষে তার নিজের অবলম্বন নিজেকেই হতে হবে। এটা কোনো পুরুষ বা সমাজ এসে তার হাতে তুলে দেবে না। এই অবস্থানে নারীকেই পৌঁছাতে হবে।’
লেখক, সংগঠক, প্রকাশক (সহিত্যবন্ধন) জেসমিন দীপা বলেন, ‘বিয়ে হলো একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি; যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিভিন্ন দেশে সংস্কৃতিভেদে বিয়ের সংজ্ঞার তারতম্য থাকলেও সাধারণভাবে বিয়ে এমন একটি সম্পর্ক, যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও বৈধ সম্পর্ক সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিয়ে প্রকৃত পক্ষে সর্বাঙ্গীন সুন্দর একটি বিধান৷ একটা বয়সে নারী পুরুষ উভয়ের স্বপ্ন তৈরি হয় বিয়ে নিয়ে, ভবিষৎ নিয়ে, সেই দিনগুলো নিয়ে সুন্দরভাবে জীবন কাটানোর প্রস্তুতি৷’
এই সংগঠক বলেন, ‘‘বিয়ের কিছুদিন পরেই অধিকাংশ মানুষ অনুভব করতে শুরু করে ‘ভুল করেছি’। স্বপ্নে যেমন ছিল বাস্তবতা তেমন নয়৷ শুরু হয় টানাপড়েন৷ বাড়তে থাকে দূরত্ব ৷ বন্ধন যা কিছু লোক দেখানো৷ ততদিনে হয়তো সংসারে আগমন ঘটে সন্তানাদির৷ সঙ্গে যোগ হয় লোকে কী বলবে? এই দুইয়ের জাঁতাকলে পিষ্ট হয় দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তি, শুধু বেঁচে থাকে মেনে নেওয়া আর মানিয়ে চলা৷’’ তিনি বলেন, ‘ভেতরে প্রতিদিন কষ্ট নামক লাভা উদ্গীরন হয়, তবু আঁকড়ে ধরে রাখার নিত্য লড়াই অব্যাহত থাকে। আর হয় নিত্য দিনের মৃত্যু৷ স্বপ্নহীন করুণ জীবন ৷ যদি লড়তে পারো, থাকে সক্ষমতা; তবে লড়াই করো। নয়তো মানিয়ে নেওয়ার ও মেনে চলার প্রচলন ছাড়ো৷’