Skip to content

২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিজ্ঞানের ইতিহাসে আশ্চর্য নারী মেরি কুরি

বর্তমানে আমরা সকলে বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই নির্ভরশীলতার মাঝেও ‘বিজ্ঞান’, শব্দটি মানুষের কাছে একাধারে যেমন আশ্চর্যের আবার কঠিনও বটে। আমাদের সমাজের নারীর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সবার একটি ধারণা, নারীরা জটিল কোনো হিসাব-নিকাশ বুঝতে পারে না। আর এই ধারাবাহিকতায় নারীরা যে বিজ্ঞানে কোনো অবদান রাখতে পারেন, তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মানতেই নারাজ। বর্তমান প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন হলেও উনবিংশ শতকে এ বিষয়টি এতটা সহজ ছিল না৷ তবে সেই পরিস্থিতিতেও সমাজের ধারণাকে উল্টে দিয়েছিল মেরি কুরি।

বিজ্ঞানের ইতিহাসের বই ছাপিয়ে যদি কারও নাম রঙিন কালি দিয়ে লিখতে হয় তবে তার মধ্যে মেরি কুরির নাম থাকবে একদম গোড়ার দিকে। এরপর যদি বলেন নারীর সফলতার কথা, তবেও তার নাম শুরুর দিকেই বলতে হবে। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণার জন্য পুরো পৃথিবী তাকে মনে রাখবে। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞানের দুটি শাখায় (পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে) নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নারী হিসেবে প্রথম নোবেল জয়ের কৃতিত্বটাও তারই। তবে এত সাফল্য তো আর এমনি এমনি উড়ে আসেনি। তার জীবনসংগ্রামের রয়েছে লম্বা এক গল্প।

মেরি কুরির জন্ম ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর পোল্যান্ডের ওয়ার্স শহরে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। মাত্র দশ বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি। তার কিছুদিনের মাথায় বোনকেও হারান তিনি। যা তার জীবনকে অনেকটাই অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়৷ একদিকে মায়ের মৃত্যু অন্যদিকে বাবার আর্থিক সংকট সবকিছু মিলিয়ে মেধাবী মেরির পড়াশোনা পরে যায় সংকটে। মেরি ও তার বোন একটি ভ্রাম্যমাণ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

মেরি ও তার বোন পরিবারের ওই আর্থিক সংকটের মধ্যে একসঙ্গে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারতেন না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেন। আগে মেরির বোন পড়াশোনা শেষ করবে আর তার খরচ জোগাবেন মেরি এরপর তিনি খরচ জোগাবেন মেরির পড়াশোনার জন্য। যেমন কথা, তেমন কাজ। মেরি এক আইনজীবীর বাড়িতে গভর্নেসের চাকরি নেন৷ একসময় মেরির বোন পড়াশোনা শেষ করে ডাক্তার হোন এবং মেরি পড়াশোনা শুরু করেন৷

কিন্তু এরপরই বাধে বিপত্তি। ওই যে শুরুতেই বললাম নারীকে বিজ্ঞানের মতো জটিল বিষয়গুলোতে মানতে সমাজ একদমই নারাজ। তাই তাকে তখন শুনতে হয়েছিল বিজ্ঞান মেয়েদের জন্য নয়, তিনি বরং রান্নার ক্লাসে যোগ দিতে পারেন। তবে মেরি কোনো অবস্থাতেই থেমে যাওয়ার পাত্রী ছিলেন না। ১৮৯১ এর শেষের দিকে মেরি পোল্যান্ড থেকে ফ্রান্সের উদ্দেশে পাড়ি জমান। তিনি প্যারিসের সোরবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পদার্থবিজ্ঞানে, রসায়নে ও গণিতে অধ্যয়ন করতে থাকেন।

১৯৮৩ সালে তাকে পদার্থবিজ্ঞানে ডিগ্রি দেওয়া হয়। এরপর তিনি গ্যাব্রিয়েল লিপম্যানের শিল্পভিত্তিক গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে তিনি আরেকটি ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে ফেলোশিপ পেয়ে যান। এরপর আর মেরিকে কোনো সমস্যার মুখের পরতে হয় না। তিনি ভালোভাবে বাকি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন৷ এরপর একপর্যায়ে তার জীবনে আসেন বিজ্ঞানী পিয়েরে কুরি।

মেরির গবেষণা কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য বড় একটি গবেষণাগার প্রয়োজন ছিল। তাই অধ্যাপক জোজেফ কোভালস্কি যিনি মেরিকে সব ব্যাপারে সাহায্য করতেন তিনি পিয়েরের সঙ্গে মেরির পরিচয় করিয়ে দেন। মেরিকে দেখেই পিয়েরে তার প্রেমে পড়ে গেলেন। এরপর দুজনে মিলে বিভিন্ন গবেষণার কাজ করেন। গবেষণা চলার সময়ে তাদের মাঝে তীব্র ভালোলাগা ও ভালোবাসার জন্ম নেয়। একদিন পিয়েরে সাহস করে মেরিকে প্রস্তাব দিয়ে বসেন। কিন্তু মেরি ছিলেন বাস্তববাদী। তিনি নানা অজুহাতে পিয়েরেকে ‘না’ বলতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত পিয়েরের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। ১৮৯৫ সালের ২৬ জুলাই দুই পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিয়ে হয়।

এরপর মেরি ও পিয়েরে নতুন উদ্যমে যৌথভাবে গবেষণা শুরু করেন। ১৮৯৮ সালে এই দম্পতি প্রথমে প্লিচব্লেন্ড থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ পলোনিয়াম এবং পরে রেডিয়াম আবিষ্কার করেন, যা ইউরেনিয়াম হতে দশ লক্ষগুণ বেশি শক্তিশালী। এই রেডিয়ামের ব্যবহার অপরিসীম। কুরি দম্পতি প্রমাণ করলেন যে, কোনো কোনো মৌলের পরমাণু ক্রমাগত ভেঙে গিয়ে রশ্মি বিকিরণ করে। এই বিকিরণ অন্য কোনো পদার্থ ভেদ করেও যেতে পারে। এই ধরনের পদার্থকে বলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ, আর এই গুণকে বলে তেজস্ক্রিয়তা। এ আবিষ্কারের জন্য মেরি ও পিয়েরে ১৯০৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান।

এই দম্পতির ঘরে ছিল দুই সন্তান। সব মিলিয়ে সুখেই কাটছিল তাদের জীবন। তবে সে সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় পিয়েরের। এতে করে মেরি শোকে একদম ভেঙে পড়েন। তবে তিনি হার মানেননি। মেরি তার ভালোবাসাকে ধারণ করে এগিয়ে নিলেন অসমাপ্ত কাজ। ১৯১১ সালে প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে পেলেন দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার, তবে এবার রসায়নে। এরপর তিনি শুরু করলেন তেজস্ক্রিয়তাকে কিভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে কাজে লাগানো যায় সে কাজ।

কথায় বলে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে সবই সম্ভব। তিনি এক্স-রে যন্ত্র ও ভ্রাম্যমাণ রেডিওগ্রাফির উন্নয়ন করেন যেগুলো পরবর্তী সময়ে ‘পেটিটস কুরিস’ (ছোট কুরিগুলো) নামে পরিচিতি পায়। এমনকি তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ২০টি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালগুলোতে রেডিওলজিকাল ইউনিট পরিচালনা করেন। তার সে অবদানের কারণে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অভাবনীয় সফলতা আসে। যার ফল তো বর্তমান সময়ে আধুনিক বিশ্বে দেখতেই পাচ্ছি।

তবে বিশ্বকে এতোকিছু উপহার দিতে গিয়ে একপর্যায়ে থেমে যায় তার নিজের জীবনই। দিনরাত তেজস্ক্রিয় মৌল নিয়ে নাড়াচাড়ার ফল ভালো হলো না। অচিরেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই এই মহীয়সী নারীর মৃত্যু হয়। তবে বিশ্ববাসী তার অবদানকে ভোলেননি। এই নারী একাধারে যেমন বিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন, তেমনি অবদান রেখেছেন নারীর অগ্রযাত্রায়।

অনন্যা/এসএএস

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ