ইনকার তিন ঘুমন্ত মমি
পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা গুলোর মধ্যে অন্যতম হল ইনকা সভ্যতা। পঞ্চদশ শতকের সবচেয়ে বড় সভ্যতা ছিল ইনকা। প্রযুক্তি এবং আভিজাত্য এই দুইয়ের মিশেল ছিল এই সভ্যতা। পঞ্চদশ শতকে আমেরিকার সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল ইনকাদেরই। প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে ছিল এই সভ্যতা। মিসরীয় সভ্যতার মতো ইনকা সভ্যতাও আধুনিক বিশ্বের কাছে আজো রহস্যময় রয়ে গেছে। অনেক রহস্য আছে ইনকা সভ্যতাকে ঘিরে , যা আজও উদ্ধার হয়নি। একটু একটু করে সেই রহস্য সমাধানের চেষ্টা করছেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা।
এর মধ্যে সবচেয়ে অবাক করে দেয়া রহস্য হল তিন ঘুমন্ত শিশুর মমি উদ্ধার। ১৯৯৯ সালে ১৬ মার্চ আর্জেন্টিনার লুলাইমাকো পর্বতের মধ্যে আগ্নেয়গিরির একটি গুহা থেকে উদ্ধার করা হয় এই তিনটি মমি। তাও আবার তিন শিশুর মমি। কাদের মমি এগুলো? এখানে কি করেই বা এলো? আর কীভাবেই বা মারা গিয়েছিলো এই তিন ফুটফুটে শিশু? এই প্রশ্নগুলো নিশ্চয়ই আপনার মনে উদয় হয়েছে। অস্বাভাবিকও নয় উদয় হওয়া। আজ আমরা ওই তিন শিশু সম্পর্কে ও ইনকা সভ্যতার কিছু বিচিত্র বিষয় সম্পর্কে জানব।
সেই তিন মমি
আন্দিজ পর্বতের মাথায় লুলাইলাকো থেকে মাটি খুঁড়ে বার করা হয়েছিল ওই তিন মমি। মমিগুলো এমন যেন তিনটি শিশু ঘুমন্ত অবস্থায় বসে আছে। অর্থাৎ হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থায়ই তাদের মৃত্যু হয়েছিলো। তাদের মধ্যে দুজন মেয়ে ও একজন ছেলে। বড় মেয়েটির বয়স ১৩ বছর আরেকজনের বয়স ছয় বছর। আর ছেলেটির বয়স সাত বছর। ওর মাথায় একটা পাগড়ী জাতীয় কিছু একটা ছিল। এ পাগড়ীর অর্থ তার সামাজিক মর্যাদা ছিল অনেক বেশি। প্রত্যেকেরই পোশাকে বেশ রাজকীয় ভাব ছিল। বেশভূষায় মনে হয়েছিলো তারা বেশ ধনী পরিবারেরই সন্তান। তাদের শরীরের একটা আঁচড়ও নেই বিশ্লেষকরা জানান, এই তিন মমির বয়স ৫০০ বছর। যেখানে মমিগুলি মিলেছে সেটি বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল। দক্ষিণ আমেরিকার আটাকামা মরুভূমির আন্দিজ পর্বতমালার লুলাইলাকোর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২ হাজার ১১০ ফুট।
‘ইনকা’ শব্দের অর্থ সূর্যের সন্তান। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ইনকারা সূর্য দেবতার আরাধনা করতো। তারা বিশ্বাস করতো সূর্যই পৃথিবীর একমাত্র দেবতা। জেনে অবাক হবেন যে বিশ্বাস থেকেই তারা ওই তিন ফুটফুটে শিশুকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের মধ্যে ১৩ বছরের নাবালিকাকে ‘লুলাইলাকো কুমারী’ নাম দেওয়া হয়। লুলাইলাকো ছিল ইনকাদের শ্মশান। তাকেই মূলত ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা হয়েছিল। বাকি দুই খুদেকে রাখা হয়েছিল তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য।
৫০০ বছর পূর্বে ইনকা সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত এই শহরের নাম ছিল কুজকো। সেখানে প্রচলিত ছিল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের। এই অনুষ্ঠানে একজন শিশুকে বাছাই করা হতো দেবতাদের কাছে উৎসর্গের জন্য। মজার ব্যাপার হল এই উৎসর্গের অংশ হওয়াকে ভাগ্যের ব্যাপার বলে ধারণা করা হতো। স্বাস্থ্যবান, সুদর্শন, রোগহীন এক কথায় নিখুঁত শিশুকে নির্বাচন করা হতো। এই শিশু নির্বাচনের জন্য একাধিক পরীক্ষাও দিতে হতো এলাকার শিশুদের। সেবার একাধিক কলা দেখিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন ওই ১৩ বছরের শিশু মেয়েটি। ইনকাদের এ ধর্মীয় অনুষ্ঠানটার নাম ছিল ‘কাপাকোচা’। ইনকাদের বিশ্বাস ছিল, পাহাড়ের নীচে তাদের ফেলে দেওয়া হলেও কখনও তারা মারা যাবেনা। বরং তারা চিরদিন বেঁচে থাকবে। সন্তানদের উৎসর্গ করে গর্ব বোধ করতেন মা-বাবা। তাঁদের ধারণা ছিল, এতে সন্তান অমর হবে, ঈশ্বরের কাছে ঠাঁই হবে তার। তারা বিশ্বাস করতো এই উৎসর্গকৃত শিশু পরিবার ও সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে। যেকোনো অশুভ ছায়া থেকে কুজকো শহরকে বাঁচাবে এই শিশু। আর এই শিশুর সঙ্গী হিসেবে পাঠানো হতো আরো দুই শিশুকে। এই দুই শিশুকেও বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে বাঁছাই করা হতো। আরেকটি বিষয় হল, নির্বাচিত এই শিশুরা প্রত্যেকেই সমাজের উচ্চ শ্রেণীর ছিল। ক্ষমতাবান ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানকেই এক্ষেত্রে নির্বাচন করা হতো। আর এই উৎসর্গকে অত্যন্ত পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
কীভাবে মৃত্যু হয়েছিলো তাদের
উদ্ধার করা এই তিন শিশুর মমি নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা। কিন্তু পরীক্ষার পর তাঁরা মৃত্যুর কারণ জেনে আরও বিস্মিত হয়েছিলেন। তাদের মৃত্যুর বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই কেবল মদ খাইয়ে রাখা হয়েছিলো তাদের। ধারণা করা হয় ছয় মাস থেকে অন্য সকল খাবার বাদ দেয়া হয়েছিলো তাদের। কেবল কোকো পাতা এবং ভুট্টা দিয়ে তৈরি মদ খেয়ে তারা জীবনের শেষ ছয় মাস অতিবাহিত করে। তাদের উৎসর্গের নির্ধারিত দিন যত ঘনিয়ে আসে মদ খাবার মাত্রাও তত বাড়িয়ে দেয়া হয়। তাদের প্রত্যেকের শরীরেই এই মদ পাওয়া যায়। ভয় কাটাতে এবং শারীরিক কষ্ট কমাতেই মূলত তাদের এই মদ খাওয়ানো হতো।
এরপর নির্ধারিত দিনে তাদের লুলাইমাকো পর্বতের গুহায় রেখে আসা হয়। লুলাইলাকো ছিল ইনকাদের শ্মশান। তাদের সাথে বেশ কিছু সিপাহিও পাঠানো হয়। তবে কিছু দূর পর্যন্ত গিয়ে সিপাহিরাও ফিরে আসে। এই তিন শিশুকে নির্জন এই পর্বতে ছেড়ে আসে মরার জন্য। একটু একটু করে শক্তি হারাচ্ছিল তাদের শরীর। বসে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তারা। ধারণা করা হয়, তখনই বসে থাকা মৃতপ্রায় ওই শিশুদের মাটির পাঁচ ফুট নীচে কফিনবন্দি করা হয়েছিল। এতদিন পরও তাদের মৃতদেহ বসে ঘুমিয়েই রয়েছে। দীর্ঘ ৫০০ বছরেও ঘুম ভাঙ্গেনি তাদের। আর ভাঙ্গবেওনা কখনো।
অক্ষত শরীর
মৃত্যু বা দাফনের এতদিন পরে তাদের মমি উদ্ধার হলেও এই তিন শিশুর শরীর পুরোপুরি অক্ষতই রয়েছে। তাদের ভিতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলিতে পচন ধরেনি। তাদের শরীরের মতো গায়ের জামাটিও অক্ষত রয়েছে। এমনকি তাদের চুলও ঠিক সে ভাবেই রয়ে গিয়েছিল। এক জনের হৃৎপিণ্ডে আবার এত বছর পরেও জমাট বাঁধা রক্ত মিলেছে। কি ব্যাপারটা আশ্চর্যর না? বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, তাদের শরীরে ডিহাইড্রেশন শুরুর আগেই তারা মমি হয়ে গিয়েছিল। তার উপর আটাকামা বিশ্বের সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চল। শুষ্ক বায়ুর কারণেই এত বছর ধরে এত সুন্দর সংরক্ষণ হয়েছে দেহগুলির। শুকনো বাতাস এবং ঠাণ্ডা আবহাওয়া দু’টিই শরীরে পচনের হার কমিয়ে দেয়। লুলাইলাকোর এই তাৎপর্যপূর্ণ আবহাওয়াই মমিগুলিকে এত বছর ধরে ভাল রেখেছিল।
বর্তমানে আর্জেন্টিনার সাল্টায় মিউজিয়াম অব হাই অলটিটিউট আর্কিওলজিতে এই তিন মমি সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সাল্টাও ইনকা সভ্যতার অংশ ছিলো। পরবর্তীতে ১৩ বছর বয়সের বড় মেয়েটিকে লা ডনসেলা নাম দেয়া হয়। তাদের সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত আবহাওয়াও তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিমভাবে। একটি বিশেষ পাত্রে তাদের সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। একটি বাক্সের মধ্যে একাধিক কাঁচের পাত্র ব্যবহার করে লা ডনসেলা অর্থাৎ বড় মেয়েটিকে এখন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। যে ঘরটিতে তাকে রাখা হয়েছে সেটি মৃদু আলোকিত। আর কখনও অন্ধকার হয়ে গেলে তার দিকে আলো ফেলে তাকে দেখা যায়।
এতো উৎসর্গের মাধ্যমেও কিন্তু ইনকারা তাদের সভ্যতাকে ধরে রাখতে পারেনি। রাজা মানকো পরাজিত হওয়ার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয় ইনকা সাম্রাজ্য। কালের চক্রে হয়তো একদিন চলে যেতে হবে সবাইকেই। নরবলি, উৎসর্গ এসব অন্ধ বিশ্বাস কেবল পীড়া বৃদ্ধি করবে। কোন কিছুকে স্থায়ীভাবে বাধতে পারবেনা।