Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মার্থা গেলহর্ন: জীবন সমর এড়িয়ে সমর সাংবাদিকের গল্প 

নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে চেনেন না এমন সাহিত্যপ্রেমী পাওয়া দুষ্কর। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন যথেষ্ট বিতর্কিত। প্রেমের ক্ষেত্রেও সে কথা সমান প্রযোজ্য। হেমিংওয়ে জীবনে তিনটি বিয়ে করেন। তাঁর তৃতীয় স্ত্রী মার্থা গেলহর্নের কথা হয়তো অনেকেই শোনেন নি। কিন্তু মার্থা গেলহর্ন ইতিহাসের পাতায় বিশেষভাবে স্মরণীয়। যুদ্ধ সাংবাদিকতাকে তিনি এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। 

 

মার্থা গেলহর্ন: জীবন সমর এড়িয়ে সমর সাংবাদিকের গল্প 

 

যে সময়ের কথা বলছি, সেসময় যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর মধ্যে হতাশা, গ্লানি এবং ধ্বংসের উৎসব। যুদ্ধ সাংবাদিকতা সম্পূর্ণরূপেই পুরুষদের দখলে। সেখানে নারীদের যেন ঠাঁই ছিলোনা। স্বভাবতই যুদ্ধের ময়দানে তো আর নারীদের যাতায়াত নিরাপদ না। এই নিরাপত্তার অজুহাতে নারীদের যেন অনেকটা কোণঠাসা করেই রাখা হয়েছিলো। কিন্তু সেই ভাবনায় ছেদ ঘটাতেই যেন মার্থা গেলহর্নের আবির্ভাব। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি একজন লেখকও বটে।

 

মার্থা গেলহর্নকে নিয়ে আলোচনা হয়তো এত বেশি এখন হয়না। অন্যদিকে তার স্বামী হেমিংওয়ে এখনো সাহিত্য জগতে ভাস্বর। সে হোক, মার্থার জীবনকে ঠিক বর্ণিল বলা চলেনা। তবে মার্থার সাহসিকতা এবং কাজের প্রতি উৎসাহ ইতিহাসে তাকে ঠাঁই দিতে বাধ্য। মার্কিন অঞ্চলে তিনি বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ সমর সাংবাদিক অভিধা পেয়েছেন। দীর্ঘ ষাট বছর অক্লান্তভাবে তিনি সাংবাদিকতায় নিজের সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে গেছেন।

 

মার্থা গেলহর্ন: জীবন সমর এড়িয়ে সমর সাংবাদিকের গল্প 

 

১৯০৮ সালে মিসৌরিতে এডনা এবং জর্জ গেলহর্নের ঘরে মার্থার জন্ম। বাবা পেশায় ডাক্তার এবং মা সামাজিক সংগঠক। সম্ভবত পারিবারিকভাবেই নিজেকে মেলে দেয়ার স্বভাবটুকু পেয়েছিলেন। মার্থা ব্রায়ান মায়ার কলেজে ভর্তি হলেও লেখাপড়া শেষ করতে পারেন নি। এর কারণ অবশ্য সহজ। চারদিকে ছুটোছুটি করতে থাকা মার্থার কখনই একাডেমিকে সময় দেয়ার ফুরসত ছিলোনা। সাংবাদিক হওয়ার দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা তাকে পেয়ে বসেছিলো। ১৯৩০ এর এক বসন্তে প্যারিসে আসার পর সেই ইচ্ছেতেই যেন নতুন করে বাতাস বইতে শুরু করে। নিজের স্বপ্ন পূরণ করার জন্যে স্বল্পমূল্যে টাইপরাইটারের কাজ গ্রহণ করেন। প্যারিসেই প্রেস ব্যুরো তাকে গ্রহণ করে এবং লীগ অব নেশন্সে মার্থার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। সেখানে তিনি আস্তে আস্তে সাংবাদিকতার খুঁটিনাটি শিখে নেন।
 
এরপর ১৯৩৪ সালে তিনি স্বদেশেপ্রত্যাবর্তন করেন এবং ফেডারেল এমার্জেন্সি রিলিফ এডমিনিস্ট্রেশনে সবচেয়ে কমবয়স্ক সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। সারা দেশ ঘুরে তাকে দুর্ভিক্ষের খবর প্রচার করতে হবে। এসময়েই মার্থার সাথে লেখক হেমিংওয়ের সাক্ষাৎ হয়। সেটা ১৯৩৬ সাল। তাঁর বই "দ্য ট্রাবলস আই হ্যাড সিন" সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। মার্থাকে অবশ্য হেমিংওয়ে আগে থেকেই জানতেন। ততদিনে মার্থা বেশ কটি বইও লিখে ফেলেছেন। এই পরিচয় আস্তে আস্তে প্রণয়ে রূপ নেয়। অবশ্য এই দুই বিপরীত প্রান্তের মানুষ কিভাবে একে অপরের প্রেমে পড়েন তা অনেকের কাছেই রহস্য। সম্ভবত সাহিত্য এবং পুরুষালি ব্যক্তিত্ব মার্থাকে আকর্ষণ করেছিলো। কিন্তু সংসারের হিসেব আবার আলাদা। প্রথমদিকে হেমিংওয়ের কর্তৃত্বমূলক ব্যক্তিত্ব হয়তো মার্থাকে মুগ্ধ করেছিলো। তারা দুজন ১৯৪০ সালের নভেম্বরে বিয়ে করেন।  

 

মার্থা গেলহর্ন: জীবন সমর এড়িয়ে সমর সাংবাদিকের গল্প 

 

বিয়ের পর দুজনের বৈপরীত্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। এর আগে দুই বিয়ে করলেও মার্থা ঠিক স্বামী অন্তপ্রাণ মহিলা ছিলেন না। নিজের স্বপ্ন এবং অধিকার সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট সচেতনতা ছিলো। মার্থা এবং হেমিংওয়ের রেষারেষি আস্তে আস্তে প্রকট হয়ে ওঠে। তবে মার্থা তাঁর দাম্পত্য কলহকে কাজের ওপর প্রভাব ফেলতে দেননি। বিয়ের আগে আদর করে ডাকা "হেমিংস্টেইন" কে তিনি প্রকাশ্যে শুওর বলে গাল দিতেন। 

 

এই কলহের মাঝেই একদিন মার্থাকে কোলিয়ার্স ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে চীন রণাঙ্গনে পাঠানো হয়। হেমিংওয়ের তেমন কোনো কাজ ছিলোনা। তাই মার্থার দেখভালের জন্যেই তাকেও যেতে হয়। সেবার বার্মা রোড পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্টের স্বার্থে রেঙ্গুনেও যেতে হয়েছিলো। বিখ্যাত স্ট্র্যান্ড হোটেলে দুজনের থাকার অভিজ্ঞতা ভালো হলেও রেঙ্গুনের অভিজ্ঞতা ছিলো জঘন্য। মার্থার এই পেশা হেমিংওয়ে কোনোমতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। এসময় নিজের পেশার প্রতি মার্থার বিশ্বস্ততা এবং ভালোবাসার প্রকাশ পাওয়া যায় এই ঘটনায়। হেমিংওয়ে খোঁচা দিতেই মার্থাকে বলেন, "মার্থা মানবতাকে ভালোবাসে বলে কাজ কর। কিন্তু মানুষকে ঘৃণা করে।" মার্থা খোঁচাটুকু বুঝতে পেরেই বলেন, "আমার কাজটাই এমন যে খবর খুঁজতে বাইরে ঘুরতে হয়। আর আর্নেস্ট ঘরে বসে থাকে। ওর অধিকাংশ আইডিয়াই আসে বেশ্যাপাড়া থেকে।"  

 

অবশেষে ১৯৪৫ সালে দুজন বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে এই তেতো সম্পর্কের অবসান ঘটান।

 

মার্থা গেলহর্ন: জীবন সমর এড়িয়ে সমর সাংবাদিকের গল্প 

 

এবার মার্থাকে আবার নতুন করে পথ চলতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিলিটারিরা নারী রিপোর্টারদের রণাঙ্গনে সাংবাদিকতা করার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু মার্থাকে তো আর দাবিয়ে রাখা সম্ভব না। খোদ হেমিংওয়ের মতো জাদরেল মানুষ মার্থাকে দমাতে পারেনি। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকেই মার্থা সাবমেরিন যুদ্ধের রিপোর্ট করেন। কোনোরকম ফরমাল প্রেস কনফারেন্স ছাড়াই তিনি ইউরোপে চলে আসেন। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং ন্যুরেমবাগ ট্রায়াল নিয়ে করা রিপোর্ট তার সাহসিকতারই পরিচয় দেয়।

 

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়েও মার্থা যথেষ্ট ছুটোছুটি করেছেন। উদ্বাস্তু ক্যাম্প ও হাসপাতাল প্রদর্শন করে তিনি অসংখ্য রিপোর্ট করেছেন। বিশেষত ফরেন এফেয়ারের সাথে জড়িত মানুষেররা তার ডকুমেন্টারিগুলোর প্রতি মনোযোগ দিতে বাধ্য হন। বিশেষত ১৯৯৪ সালে শিশুদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের বিষয়ে লেখা নিবন্ধটি প্রশংসার দাবী রাখে।

 

দীর্ঘ ষাট বছরের সাংবাদিকতা জীবন শেষে মার্থা যুক্তরাজ্যে বসবাস শুরু করেন। এই সময়ে নতুন প্রজন্মের লেখক ও সাংবাদিকদের সাথে তার বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে। মার্থার কাজ হয়তো সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্য। যেন ধাতু দিয়ে গড়া তাঁর ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন মার্থার খুব সুখকর ছিলোনা। হেমিংওয়ের সাথে বিবাহবিচ্ছেদ তো অনেকেই জানেন। ১৯৫৪ সালে টম ম্যাথিউকে বিয়ের পর মার্থা কিছুদিন যেন কাজে জড়াননি। কিন্তু ১৯৬৩ সালে ম্যাথিউর সাথেও বিবাহবিচ্ছেদ হয়। একমাত্র সন্তান স্যান্ডি গ্যালহর্নের সাথেও তাঁর মনোমালিন্য লেগেই ছিলো। স্যান্ডি ওজন কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। একসময় স্যান্ডিকে মাদকাসক্তির জন্যে গ্রেপ্তার করা হয়। এই সময় মার্থার সাথে সন্তানের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যদিও পরবর্তীতে আবার দুজন একসাথে দেখা করার সুযোগ পান।    

 

মার্থা গেলহর্ন: জীবন সমর এড়িয়ে সমর সাংবাদিকের গল্প 

 

ব্যক্তিগত জীবন বা আক্ষেপ নিয়ে কখনই মার্থা কোনো কথা বলতেন না। মানবতা এবং মাতৃভূমির ভেজা মাটির আকূল ঘ্রাণের কথা প্রচার করা এই নারীই ১৯৯৮ সালে ৮৯ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন। পুরো পৃথিবীই অবাক এবং হুট করেই মার্থার ব্যক্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত না হয়ে সকলে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের খোঁজ শুরু করে। অসংখ্য প্রতিকূলের মাঝেও তিনি তাঁর পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। মৃত্যুর পর মরণোত্তর পুলিৎজার পুরষ্কার লাভ করেন মার্থা। এমনকি তাঁর নামে সাংবাদিকতার অন্যতম সম্মানজনক পুরষ্কার মার্থা গেলহর্ন প্রাইজ চালু হয়।   

 

মার্থা গেলহর্ন নারী সাংবাদিকদের জন্যে একজন অনুকরণীয় আদর্শ। বিশেষত ব্যক্তিগত জীবনের নানা সমস্যাকে লুকিয়ে রেখেছেন বলেই তিনি ছিলেন রহস্যময়ী। সমগ্র বিশ্বের কাছে মার্থা গেলহর্ন এখনো সাহসিকতা এবং পেশার প্রতি আত্মনিবেদনের ধ্রুব উদাহরণ। 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ