ট্রান্সজেন্ডার নারীকে ঘৃণা বনাম যৌন হয়রানি!
আমাদের সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য ব্যাপারটি নতুন কিছু নয়। নারী-পুরুষ নিয়ে বর্তমানে সমাজে অনেক আলোচনা, সমালোচনা, আন্দোলন, প্রতিবাদ সবই হয়। এরপর যদি বলি তৃতীয় লিঙ্গের বিষয়টি, তা নিয়েও বর্তমানে সমাজে টুকটাক কথোপকথন হয়, তাদের অধিকার নিয়েও আওয়াজ তোলা হয়। তবে কুয়োর ব্যাঙ হয়ে পরে আছে ট্রান্সজেন্ডার গ্রুপ। সমাজ তাদেরকে যতটা সম্ভব হেয় চোখেই দেখে। তবে অবাক করা বিষয় হলো এতোটা ঘৃণার চোখে দেখা ট্রান্সজেন্ডার নারীকেই আবার যৌন হয়রানি করতে যান সমাজেরই একদল মানুষ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে দেশ–বিদেশে সুপরিচিত সাদমুআ। অবশ্য এই নামটি জন্মের পর তার পরিবার প্রদত্ত না। তার মা–বাবার দেওয়া নাম ছায়েদ বিন রাব্বি শান্ত। তবে ট্রান্সজেন্ডার (রূপান্তরিত) নারী হিসেবে ছায়েদ নিজের নাম রেখেছেন সাদমুআ। সম্প্রতি এই ট্রান্সজেন্ডার নারীকে যৌন নির্যাতন ও হত্যা চেষ্টা'র অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগে বলা হয়, কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একজনের সাথে পরিচয় হয় সাদমুআর। ১০ জানুয়ারি তাকে ঐ লোক ফোন করে তার সঙ্গে দেখা করতে চান। সাদমুআ বাইরে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে চাইলেও ঐ ব্যক্তি এ বিষয়ে অসম্মতি জানান। সেই সময় ওই ব্যক্তি 'তার বাসা কাছেই' এবং 'সাদ মুআ সেলেব্রিটি হওয়ায় তাকে বাসায় নিয়ে স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে চান জানিয়ে তাকে বাসায় যাওয়ার অনুরোধ করেন। তার অনুরোধে সাদমুআ ওই বাসায় যান।
এরপর বাসায় ঢোকার পরে একটি রুমে নিয়ে গিয়ে তাকে নানান ধরনের কুরুচিপূর্ণ প্রশ্ন করা হয়, তার জেন্ডার নিয়েও অনেক নেতিবাচক মন্তব্য করেন একজন নারী ও একজন পুরুষ। তারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক বলে পরিচয় দেয়। তাদের সঙ্গে অস্ত্র ও ওয়াকিটকিও ছিল। তাদের কথা না শুনলে বা টাকাপয়সা না দিলে তাকে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি দেয়। এরপর তাকে বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি করা হয় ও তার পোশাক খুলে ভিডিও বানানো হয়। এরপর তার মুঠোফোন, চেইন, বিকাশের টাকা নিয়ে নেয় এবং তাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার নাম করে রামপুরার দিকে একটি খাবারের দোকানে তাকে বসিয়ে চলে যায়।
এরপর কিছু মানুষের পরামর্শে সাদমুআ ১৩ জানুয়ারি ভাটারা থানায় যান। তবে বিভিন্ন তথ্যপ্রদানসহ আরো কিছু জটিলতা কাটিয়ে ২১ জানুয়ারি ভাটারা থানায় মামলা দায়ের করেন তিনি। সাদমুআ'র ওপর যৌন নির্যাতন ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগে মামলার পরেই এই বিষয়ে র্যাব তদন্ত শুরু করে এবং র্যাবের অভিযানে তিনজন গ্রেপ্তার হয়।
এই ঘটনাটি আলোচনায় আসলেও তা গুটিকয়েক মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। বরাবরের ন্যায় খুব বেশি প্রতিবাদও দেখা যায়নি বিষয়টি নিয়ে। বরং বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশ করা সংবাদের নিচে কমেন্ট বক্সে দেখা গিয়েছে বিভিন্ন অপ্রীতিকর মন্তব্য। এর নেপথ্যে রয়েছে একটিই কারণ। আর তা হলো, সাদমুআ একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী৷ আমাদের সমাজ ট্রান্সজেন্ডার নারী-পুরুষদের একধরনের অপরাধীই বানিয়ে রাখে।
সাদমুআর সাথে এরূপ আচরণের প্রধান কারণও বলা যায়, তিনি একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী। তবে তিনি দেশ বিদেশে নামকরা একজন বিউটি ব্লগার হওয়া সত্ত্বেও তাকে এমন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাহলে সাধারণ ট্রান্সজেন্ডার নারীদের ঠিক কতটা অসহায়ভাবে আমাদের সমাজে দিন পার করতে হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাদের সাফল্যও খুব একটা আমাদের চোখে পরেনা কারণ তারা ট্রান্সজেন্ডার।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য পরে বোঝা যাচ্ছিলো সমাজের সাধারণ মানুষ তাদেরকে কতটা ঘৃণার চোখে দেখে৷ নিজেদের পাপপুণ্যের হিসেবও কষে ফেলে এসব মন্তব্যের মাধ্যমে৷ আবার সেই ট্রান্সজেন্ডার নারীকেই যৌন হয়রানি করতে পিছপা হোন না সমাজেরই একদল মানুষ।
একজন নারীকে হয়রানি বা ধর্ষণের ঘটনাকে আমাদের সমাজ অপরাধ বলে মনে করলেও বেশিরভাগ মানুষই একজন ট্রান্সজেন্ডার নারীর বেলায় এ বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ। এক্ষেত্রে অপরাধ বিবেচনায় আসে মানুষের লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে। তাইতো অপরাধীও ছক কষে এসব মানুষদের নিয়েও। আর বিউটি ব্লগার সাদমুআর বিষয়টিই যেনো এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।