পথশিশু ধর্ষণ ও আমাদের দায়সারা মনোভাব

'ধর্ষণ' শব্দটি আকারে বেশ ছোট, তবে নিঃসন্দেহে ভয়ংকর। তবে আজকাল আর ঠিক আগের মতো 'ধর্ষণ' শব্দটি শুনলে গা শিউরে উঠে না। 'ধর্ষণ' শব্দটির সাথে বেশ অনেকটা অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গেছে । প্রতিদিনকার খবরের কাগজে 'বাবার হাতে মেয়ে ধর্ষণ', 'বোনকে ধর্ষণ করলেন ভাই', 'শিক্ষক ধর্ষণ করলেন ছাত্রীকে', 'স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ ' এমন বড় বড় অক্ষরে লেখা শিরোনামগুলো দেখি, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলি, আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই।
সম্প্রতি আবারও খবরের কাগজের প্রধান শিরোনাম ধর্ষণ। আর এবার ধর্ষণের শিকার মাত্র ১২ বছর বয়সী এক পথশিশু। ধর্ষণের শিকার মেয়েটি রাজধানীর পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কে ভাসমান পথশিশু হিসেবে থাকত। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যান সিদ্দিক নামের এক বখাটে।
পরে কেরানীগঞ্জে নিয়ে তাকে একটি রুমে বন্দী করে ধর্ষণ করেন সিদ্দিক । একই সঙ্গে মধ্যযুগীয় কায়দায় তাকে নির্যাতনও করা হয়। পরে ওই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে র্যাব সেখানে পৌঁছে মেয়েটিকে উদ্ধার করলেও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় সিদ্দিক নামের সেই বখাটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিশু বাদী হয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মামলা করে। এরপর শুক্রবার অভিযান চালিয়ে র্যাব সিদ্দিককে গ্রেপ্তার করে।
পথশিশুদের ধর্ষণের চিত্রও আমাদের দেশে নতুন নয়। এর আগে চলতি বছর ২৯ এপ্রিল কক্সবাজার শহরে আট বছরের এক পথশিশু সমুদ্রসৈকতের সিগ্যাল পয়েন্টে তিন যুবকের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়। গতবছর মার্চ মাসে ঢাকার বিমানবন্দর রেল স্টেশনের পাশে এক পথশিশু ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনাও বেশ আলোচনায় আসে। রাত দেড়টার দিকে রেল স্টেশনের পূর্ব পাশের ঝোপের ভেতর দুই-তিনজন মিলে শিশুটিকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
শুধু রাজধানীতেই নয়, রাজধানীর বাইরেও পথশিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে পঞ্চগড় সদর উপজেলায় এক পথ শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে দুলাল হোসেন নামের ৪২ বছর বয়সী এক ব্যক্তির উপর। সে বছর ১৭ আগস্ট রাতে দুলাল শিশুটিকে ধর্ষণ করে। পরদিন শিশুটি দূরসম্পর্কের মামা মতিনকে বিষয়টি খুলে বললে। ঘটনাটি স্থানীয়দের মধ্যে জানাজানি হয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে দুলাল ওই শিশুটিকে মারধরও করে। পরে অবশ্য অভিযুক্তকে পুলিশ গ্রেফতার করেন।
যেহেতু পথশিশুদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন অভিভাবক থাকেনা, তাই এক্ষেত্রে ধর্ষকরা ভাবে যেকোনো ধরণের নির্যাতন করেও পার পাওয়া সম্ভব। কিছু কিছু পথশিশু বাবা- মা বা পরিচিত কারো সাথে রাস্তার পাশে বসবাস করলেও অনেকেই আবার থাকে একদম একা। রাস্তায় ভিক্ষা করে খেয়ে একা একা দিন কাটে তাদের। আর এধরণের শিশুরা বেশি হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পথশিশুদের চকলেট বা খাবারের লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে, মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষক যে উপায়ই ব্যবহার করুক না কেন মোদ্দাকথা পথশিশুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিশেষ করে যৌন নিরাপত্তা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। বেশিরভাগ মৌলিক অধিকার থেকেই বঞ্চিত একজন পথশিশু। পথশিশুদের জন্য শিক্ষা, খাদ্য, চিকিৎসা, আশ্রয় সবকিছুই যেখানে অনিশ্চিত সেখানে নিরাপত্তার প্রশ্ন অনেক দূরের ব্যাপার।
একজন স্কুলশিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হলে যে আন্দোলন বা প্রতিবাদের ঝড় ওঠে একজন পথশিশুর বেলায়ও কি তা হয় নাকি কেবলই ফেসবুকে নিন্দার ঝড় তুলেই দায়সারা। ফুটপাতে, ঝোপঝাড়ে তাদের সাথে প্রতিনিয়ত যে অন্যায় হচ্ছে সে দিকে আদৌ কি দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে? একজন ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া শিক্ষার্থী যখন বন্ধুর বাসায় গ্রুপ স্টাডি করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়, তখন পুরো দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও একজন পথশিশুর বেলায় আমাদের কেন নিশ্চুপ অবস্থান?
শুধু কি তাই, চারদিকে বয়ে চলেছে উন্নয়ন। উন্নয়নের জোয়ারে দেশ যখন ভেসে যাচ্ছে তখন সে স্রোতে কেন ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে পথশিশুদের নিরাপত্তাও? এতো এতো উন্নয়ন, বাজেটে কেন ঠাই নেই পথশিশুদের? এতো এতো অভিভাবকহীন, নিরাপত্তাহীন শিশু কিশোরকে রাস্তার দুপাশে ফেলে কোন উন্নয়নের দিকে এগোচ্ছে দেশ? প্রশ্ন রয়েছে অনেক, কিন্তু নেই যথাযথ উত্তর। কিন্তু হাজারো প্রশ্নের একটিই উত্তর, শহীদ মিনারের পাশে বিবস্ত্র পথশিশুর লাশের কথা মনে আছে? তা কেবল একটি বিবস্ত্র পথশিশুর দেহ নয় ছিল একটুকরো বিবস্ত্র বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।