কারাগারে কে, সাংবাদিক না সাংবাদিকতা?
বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের খবর নতুন নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক দেশের স্বনামধন্য পত্রিকা ‘দৈনিক প্রথম আলো’র জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ওপর নির্যাতন ও গ্রেপ্তার তোলপাড় করেছে সারাদেশকে। রোজিনার সুবিচার চেয়ে কেবল সাংবাদিকরাই নয়, সাধারণ মানুষও ফেটে পড়েছেন মানববন্ধনে।
রোজিনা ইসলামের নির্যাতনের কাহিনী আমাদের অজানা নেই। আমরা সবাই জানি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের পর আবার তাকেই আসামি সাজানো হয়! একে তারা আটকে রেখে রোজিনার ওপর নির্যাতন চালায় তার ওপর আবার নিজেদের দোষ ঢাকতে তার নামেই থানায় মামলা করে। রোজিনার নামে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ এবং দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। এর আগে একটি ভাইরাল ভিডিওতে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মীকে রোজিনার গলাও টিপে ধরতে দেখা গিয়েছে। রোজিনার ঘটনা আসলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমেরই গলা টিপে ধরার চেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে।
থানা থেকে আদালতে নিয়ে যাবার সময় দেখা গেছে অসংখ্য পুলিশ তাকে কড়া পাহারায় নিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটি দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন বিপদজনক খুনী আসামীকে কড়া সচেতনতায় আদালতে ওঠানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো দেশের একজন সাহসী, সৎ ও আপোষহীন সাংবাদিককে। রোজিনা ইসলামের এই অবস্থা যেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার পরিস্থিতিকেই উপস্থাপন করে। রোজিনার মতো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকেও কারাগারে বন্দি করে রাখা হল।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে রাষ্ট্রীয় নথি চুরি এবং অনুমতি ছাড়া সেই নথির ছবি তোলার । এর পিছনের ইতিহাসটাও দেখা উচিত কেন তাকে এভাবে হেনস্তা করা হল। বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম 'প্রথম আলো'য় তদন্ত ভিত্তিক সাংবাদিকতা করেন রোজিনা ইসলাম। গত এক বছরে রোজিনা বারবারই করোনা মহামারিকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে রিপোর্ট করছিলেন। এসব রিপোর্টের কারণে যারা বিক্ষুব্ধ হয়েছে, তাদের আক্রোশের শিকার হয়েছেন রোজিনা ইসলাম। তার করা রিপোর্টগুলোর ক্ষোভ প্রকাশ করতেই সচিবালয়ে আটকে রাখা হয়েছিলো।
রোজিনা ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করছেন। তিনি তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে অত্যন্ত সম্মানিত। তিনি তাঁর সাহসী ও অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ প্রতিবেদনের জন্য পরিচিত। তাঁর সাংবাদিকতার মূল শক্তি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। তিনি অনেক কিছু উন্মোচন করেছেন এবং তাঁর প্রতিবেদন ধরে সরকার সংশোধনমূলক পদক্ষেপও নিয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য রোজিনা ইসলাম কানাডিয়ান অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সিলেন্স ইন বাংলাদেশি জার্নালিজম (২০১১), টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার (২০১৫), পিআইবি ও দুদকের উদ্যোগে দুর্নীতি প্রতিরোধে গণমাধ্যম পুরস্কার বাংলাদেশসহ (২০১৪) বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন।
একজন সাংবাদিকের এমন হেনস্তার ঘটনা আমাদের মোটেই কাম্য নয়। সাংবাদিকদের ওপর যদি এভাবে নির্যাতন চলতেই থাকে, তাহলে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা নি:শেষ হতে আর বেশিদিন লাগবেনা। নিঃশর্তে মুক্তি দিতে হবে রোজিনা ইসলামকে। মুক্তি দিতে হবে সুস্থ সাংবাদিকতাকে।