নারীর সৌন্দর্য মননে
যুগের পরিবর্তন হলেও মানুষের মনের বদল ঘটেনি। আজও নারীকে তার সৌন্দর্য নিয়ে নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বিদ্রুপের শিকার হতে হয়। কিন্তু নারীর সৌন্দর্য কোথায়? সৌন্দর্য কি কোন বাহ্যিক আবরণ? আর বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে এ পৃথিবীর কি সত্যি কোন উপকার হয়েছে! তাহলে এ সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিকৃত বাসনা ও লালসা কেনো! তারা কেনো নারীকে এভাবে কটুক্তি করবে?
আমরা জানি, নারীর সৌন্দর্য নিয়ে মন্তব্য-কটূক্তি নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে সৌন্দর্যই যেন নারীকে টিকিয়ে রেখেছে, এমন ধারণা সমাজ দীর্ঘকাল ধরে পোষণ করে আসছে। ধারণা বললে বরং ভুলই করা হয়, বলা চলে বাস্তবতা। নারীকে গুরুত্ব দেওয়া হয় তার সৌন্দর্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে। কার গায়ের রঙ কতটা চাপা, কে কতটা ফর্সা, কে কত লম্বা, কে খাটো নানরকম ভেদ সৃষ্টি করে, তার মূল্যায়ন করা হয়। নারীকে প্রতিনিয়ত বাঁচতে হয় এই রায়ের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু নারীর সৌন্দর্য নিয়ে এত বিভেদ সৃষ্টি কেন?
নারীর সৌন্দর্যের মাপকাঠি পুরুষতান্ত্রের ফল। সমাজে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক মানসিকতা বহন করে আসছে অধিকাংশ নারী-পুরুষ। এক্ষেত্রে পুরুষের সহযাত্রী কতিপয় নারীও। লক্ষ করলেই দেখা মিলবে, বেশিরভাগ পরিবারই যখন বিয়ের জন্য পাত্রীর সন্ধানে নামে, তখন তাদের প্রধান চাহিদা থাকে পাত্রীর গায়ের রঙ যেন কোনোভাবেই চাপা না হয়। এরসঙ্গে যুক্ত হয় আরও নানারকম চাহিদা। যেন রূপই নারীর সর্বস্ব।
সামাজিক এই ট্যাবু একদিনে পাল্টানো সম্ভব নয়। তবে এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে নারীদেরই। কারণ সমস্যা যেই শ্রেণির, তারাই যদি সমাজের ধারণাকে উসকে দেয় বা বহন করে চলে, তবে পুরুষতন্ত্র কি কোনোদিনই নারীকে মুক্তি দেবে?
তথ্য-প্রযুক্তির যুগে সমাজ এগিয়ে গেছে। কিন্তু সামজের গড়ে ওঠা প্রথা- সংস্কার-কুসংস্কার-রীতি-নীতি-নিয়মের কতটা পরিবর্তন ঘটেছে? যে সমাজে নারীকে মূল্যায়ন করা হয় তার গায়ের রঙ দিয়ে, সেখান থেকে কিভাবে কল্যাণের আশা করা যায়? শুধু যে বাংলাদেশের মধ্যেই নারীর সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, এমনটা নয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বরাতে ঘুরে ফিরেই নিউজফিডে ভেসে আসছে প্রেমিকের প্রত্যাখ্যানে এক নারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার ঘটনা। তিনি প্রায় সাত লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে নিজেকে সুন্দরী করে তুলেছেন। কিন্তু নারীদের এ ধরনের মানসিকতা কি পুরুষতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেওয়া নয়? নারীর সৌন্দর্য নিয়ে বারংবার নানামাত্রার ছেলেখেলায় নারীরাই শিকারের বলি হচ্ছে। কেউ ছুটছে বাজারের নামি-দামি ব্যান্ডের ফেসক্রিম, লোশনসহ মুখের জেল্লাবৃদ্ধি নানারকম প্রসাধনীর দিকে। কেউবা নিয়ম করে দৌড়াচ্ছে বিউটি পার্লারগুলোয়। কিন্তু নারীদের সামাজিকভাবে এতটা উসকানি ও মানসিকতা সৃষ্টিকারী নেপথ্য কারণ নারীর বাজারদর।
কারণ যে নারী নিজের সৌন্দর্য বর্ধনে যতটা সময় ব্যয় করবে, ঠিক ততটাই তার একটি ভালো পাত্র জুটবে। এটাই তো সামাজিক ব্যবস্থা। কিন্তু সমাজের এই ধারার মানসিকতা গড়ে তুলতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কম দায়ী নয়। ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়া তরুণীর ঘটনাটিই কি প্রমাণ করে না যে, নারীরা নিজেরাও মস্তিষ্কে ধারণ করেছে রূপজ সৌন্দর্যকে?
নারীদের মনে এই বদ্ধমূল চিন্তা গেঁথে দেওয়ার নেপথ্য ভূমিকা আমাদের পরিবারগুলোর। সেটা দেশের বাইরেও সমান। কারণ পরিবার বেড়ে উঠতেই কন্যাশিশুকে হজম করতে হয় নানারকম কটুকথা। সেক্ষেত্রে কারও গায়ের রঙ যদি একটু চাপা হয়, তাহলেই হয়েছে। তার জীবনকে কিভাবে এবং কোন কোন প্রক্রিয়ায় নরকে পরিণত করা যায়, তা বাংলাদেশে বসবাস করা প্রত্যেক মানুষেরই জানা। তবে ইন্টারনেটের যুগে এখন শুধু দেশের বার্তাই নয় বরং বহির্বিশ্বের খবরও নিমিষেই জনসম্মুখে আসে। ফলে সবরকম খবরের সঙ্গে নারীদের উন্নতি-অবনতি সবই শোনা যায়, দেখা যায়, পড়া যায়। নারীর সৌন্দর্যকে ঘিরে আর কতদিন চলবে ঘষামাজা? এখনই সময় নারীর যোগত্যা-দক্ষতার সঠিক মূল্যায়ন করা। নারীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা, শ্রদ্ধা করা।
কিন্তু সবটা করেও কি নারী তার মনকে প্রাগসর করতে পারবে! গায়ের রঙ, শারীরিক গঠন কি সত্যি মনের কলুষতা মুক্তির চেয়ে বেশি জরুরি! এ সমাজ নারীকে চাপিয়ে দেয় সৌন্দর্য বর্ধনের নানারকম ঘোরটোপে। আর নারীরাও পুরুষতান্ত্রিক এসব মানসিকতাকে টেক্কা দিতে গিয়ে ফাঁদে পা দিচ্ছে। এসব না করে বরং নারীর প্রবৃত্তিগত পরিবর্তন প্রয়োজন, মনের উদারতা ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন, মমত্বের ভাষা জানা জরুরি যাতে দেশ-দশের কল্যাণ হয়। গায়ের রঙ, শারীরিক গঠন দিয়ে সত্যি পৃথিবী পাল্টানো যায় না। যদি তা সম্ভব হয় তাহলে মানবিক বোধ ও ভালো মানসিকতা-মনের অধিকারী দ্বারাই সম্ভব। তাই পুরুষতন্ত্রকে জিতিয়ে দিয়ে গাধার পালের মতো বিউটি পার্লারে না দৌঁড়ে বিদ্যা-বুদ্ধি ও শিক্ষায় প্রাজ্ঞ হওয়া আবশ্যক। তাহলেই পৃথিবী বদলাতে বাধ্য। মনে রাখা প্রয়োজন নারীর সৌন্দর্যর বাস তার মননেই।