Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পথের পাঁচালী: নারীর ভাগ্যলিপির প্রতিচ্ছবি

সত্যজিৎ রায় (২ মে ১৯২১-২৩ এপ্রিল ১৯৯২) পরিচালিত ‘পথের পাঁচালী’ বাংলা চলচ্চিত্র জগতে একটি অনন্য নাম। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ অবলম্বনে তৈরি ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৫ সালে। এটি সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। ছবিতে বিশ শতকের বাংলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের জীবনধারা তুলে ধরা হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান তিন নারী চরিত্র ইন্দির ঠাকুরণ, সর্বজয়া, দুর্গা। তিন জন তিন প্রজন্মের প্রতিভূ। এই তিন জনের জীবন-যাপন, অধিকার ভোগ করা নিয়ে তৎকালীন সমাজে নারীর অবস্থান কেমন ছিল, তা দেখানো হয়েছে। এই নিবন্ধে দেখার চেষ্টা করা হবে, এই সময়ে এসেও নারীর ওপর পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যের শেষ হয়েছে কি না? এখনো নারী পুরুষতন্ত্রের নিগড়ের শিকার কি না।

ইন্দির ঠাকুরণ (চুনীবালা দেবী) সবচেয়ে প্রৌঢ়। বয়স ৭৫। বৃদ্ধা, গাল ভাঙা। ইন্দির ঠাকুরণের সঙ্গে হরিহরের সম্পর্কটা বড় দূরের। মামার বাড়ির সম্পর্কের বোন। পূর্বদেশীয় এক নামজাদা কুলীনের সঙ্গে ইন্দির ঠাকুরণের বিয়ে হলেও তার স্বামীকে সম্পর্কের কোনোই মূল্যায়ন করতে দেখা যায়নি। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে দূর-সম্পর্কের ভাই হরিহরের বাড়িতে ঠাঁই হয়েছে তার। ইন্দির ঠাকুরণের জীবনজটিলতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ফল। তৎকালীন সমাজে নারীর মতকে এমনকি তার জীবনকে কতটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হতো সে সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। ইন্দির ঠাকুরণ বিধবা, সন্তানহীন হলেও সমাজের গণ্ডি পেরিয়ে নতুন করে জীবন সাজাতে উদগ্রীব হয়নি কারণ সমাজ তাকে সাহায্য করেনি। ফলে প্রতিনিয়ত তাকে জীবন সংগ্রাম করতে হয়েছে পরিবার ও সমাজের সঙ্গে।

ইন্দির ঠাকুরণ বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করে একদিকে বাবার বাড়ির সব অধিকার বঞ্চিত হয়েছে, অন্যদিকে স্বামীর কাছ থেকে পায়নি যোগ্য সম্মান। ফলে জীবনের কাছে হেরে যাওয়া ইন্দির ঠাকুরণ দূর সম্পর্কের ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সেখানেও দুঃখ-দারিদ্র্যের মাঝেই তার মৃত্যু ঘটেছে। এটা সময়ের চিত্র। সেই সময়ের সঙ্গে বর্তমান সমাজকে মিলিয়ে দেখলে চোখে পড়বে, নারী স্বাবলম্বী হতে পারেনি। তাকে কারও না কারও ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। তৎকালীন সমাজে বৃদ্ধা অসহায়কে আত্মীয়-নিকটাত্মীয় পুরুষের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে তার কিছু ছিল না। এখনো গ্রামীণ জীবনে সেই চিত্রই বহাল। এখনো নারীকে কারও না কারও ওপর নির্ভর করতে হয়। হয় আত্মীয় পুরুষ, না হয় রাষ্ট্রের অনুগ্রহের ওপর। আজকের ইন্দির ঠাকুরণরা মাঝেমধ্যে কিছুটা সরকারি সহায়তায় পায়।

হরিহরের স্ত্রী ও অপু-দুর্গার মা সর্বজয়া। প্রচণ্ড পরিশ্রমী ও সংসারের সব দায় সর্বজয়া একা কাঁধে তুলে নেয়। স্বামীর অনুপস্থিততে সন্তানের একমাত্র অভিভাবক হয়ে ওঠে। যখন দারিদ্র্যের সংসারে ইন্দির ঠাকুরণকে দেখাশোনা করেছে, ঠিক তখন সংসারের বাড়তি বোঝা মনে করে ইন্দির ঠাকুরণকে কথা শুনিয়েছে। তবে সেখানেও চিরন্তন মাতার জীবনচেতনা প্রস্ফুটিত। মা তার সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় সদা উদগ্রীব৷ সর্বজয়াও উচাটন থেকেছে। তবে তার পক্ষপাত কিছুটা পুত্রের ওপর! অপুকে পাঠশালায় দিয়েছে। তার ভবিষ্যৎ ভেবে সদা শঙ্কায় থেকেছে। দুর্গা মেয়ে বলে অনেকক্ষেত্রে তাকে নিয়ে সর্বজয়ার নিস্পৃহতা মনকে বিগলিত করে। দারিদ্র্যের শিকারেই পুত্র-কন্যার বিভেদ?

পরিবার থেকে নারী-পুরুষের ভেদাভেদের চিত্র দেখিয়ে আবহান বাঙালি সমাজকে তুলে ধরেছেন সত্যজিৎ রায়। তিনি দেখিয়েছেন, আবহমান কাল থেকে বাঙালি মায়েরা সর্বজয়া হয়ে ওঠে। পুত্র সন্তানের মঙ্গলের জন্য শত কষ্ট সহ্য করতেও পিছ-পা হন না।
সর্বজয়া ও হরিহরের ১ মাত্র কন্যা—দুর্গা। দুর্গা দুরন্ত সুবোধ বালিকা। জীবনের দ্বন্দ্ব-জটিল সমস্যা সম্পর্কে তার বুদ্ধির বিকাশ ঘটেনি! তাই খুড়ির বাড়ির গাছ ফল পাড়লেও প্রতিবেশীর রূঢ়তা সম্পর্কে তার ধারণা নেই! দুরন্তপনা দুর্গা বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরে পড়ে একসময় মৃত্যুবরণ করে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে ঠিকমতো দুর্গার ভাগ্যে ওষুধও জোটেনি। ফলে তার জীবনবাসন ঘটে। চিরকাল দুর্গারা নিজেদের পরিবারের কল্যাণের জন্য ত্যাগ করে! মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যেন পরিবারের দায় কিছুটা কমায় তারা। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় দুর্গাদের পরিবর্তন ঘটেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের অগ্রগতি বেশি হয়েছে। তবে, তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনো সম্ভব হয়নি!

ইন্দির ঠাকুরণ, সর্বজয়া, দুর্গা—তিন যুগের প্রতিনিধি হলেও নারীর জীবনের একটি বিষয় তাদের মধ্যে একসূত্রে গাঁথা। তিন প্রজন্মই সমানভাবে দুর্দশা-দারিদ্র্য আর অবহেলার শিকার। একুশ শতকে নারীজীবনের কতটা পরিবর্তন এসেছে? সর্বজয়া চিরন্তন মায়ের রূপে আজও সমাজে বিদ্যমান। ইন্দির ঠাকুরণেরা আজও অবহেলিত। তাদের জীবনকে সুগঠিত ও নিরাপদ করতে সমাজকে ব্যবস্থা নিতে হবে। দুর্গাদের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে।

সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আবহমান বাঙালি নারী যে চিত্র এঁকেছেন, তাতে পুরো সমাজকে একটি মাত্র ক্যানভাসে ত্রিমাত্রিক বিন্যাসে পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। বৃদ্ধা, প্রৌঢ় ও কিশোরী—এই তিন প্রজন্মের নারীর কষ্ট, একাকীত্ব, দায়িত্ববোধ, মানসিক দ্বন্দ্ব, কৌতূহল, অবজ্ঞা, বেঁচে থাকার প্রবল আকুতির চিত্র রয়েছে এই ছবিতে। কিন্তু ছবিতে যা দেখানো হয়নি, তা হলো নারী তার ভাগ্য নিজহাতে গড়ে তুলতে চায়নি। সে তার পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল থেকেছে। সমাজ যেদিকে ধেয়ে গেছে, সত্যজিৎ রায়ও সেদিকের ছবি তুলে ধরেছেন। ভিন্নদিকে সমাজকে পরিচালিত করার স্বপ্ন দেখাননি মানুষকে। আজকের নারীও সেই স্বভাব থেকে মুক্তি পায়নি। ২৩ এপ্রিল, সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণ দিবস। এই মহান চলচ্চিত্র নির্মাতার প্রয়াণদিবসে কুর্নিশ।

অনন্যা/জেএজে

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ