মাহবুবা আঁখি-তার নবজাতকের মৃত্যু: সুষ্ঠু বিচার হোক
সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা সেন্ট্রাল হাসপাতালে নবজাতক ও পরবর্তীকালে মায়ের মৃত্যুর ঘটনা৷ সোমবার (১৯ জুন) দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. অধ্যাপক কাজী গোলাম মোখলেছুর রহমানের নেতৃত্বে প্রভাষক ডাক্তার ফাহমিদা নার্গিস তাদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। রাজধানী ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মারা যায় মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতক ছেলে সন্তান। ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. অধ্যাপক কাজী গোলাম মোখলেছুর রহমান বলেন, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মা আঁখির মৃত্যু হয়েছে।
রোববার (১৮ জুন) দুপুর ১টা ৪৩ মিনিটে আঁখি মারা গেলেও ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে বিকেল সাড়ে ৪টায়। হাসপাতালটির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে পাঠানো হয় জনসংযোগ কর্মকর্তা চৌধুরী মেহের-এ-খোদা দীপকে। যদিও আঁখির চিকিৎসায় ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। কিন্তু মৃত্যু পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে কোনো চিকিৎসক আসেননি, বরং ব্রিফিংয়ে পাঠানো হয় হাসপাতালটির জনসংযোগ কর্মকর্তাকে।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা তার কাছে আঁখির সর্বশেষ চিকিৎসা ও মৃত্যুর কারণ জানতে চান। এসময় জনসংযোগ কর্মকর্তা দীপ বলেন, প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণে আঁখির মৃত্যু হয়েছে। এরকমটা স্বাভাবিকভাবেই হতে পারে। আঁখির শরীরের কোন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে রক্তক্ষরণ হয়েছিল সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিষয়টি পরিষ্কার করতে পারেননি।
দীপ আরো বলেন, রোগীকে অচেতন অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স যোগে ল্যাবএইড হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আনা হয়। তখন প্রসবজনিত জটিলতায় শিশুর মৃত্যু হয় এবং মায়ের অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ ও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে আনা হয়।
গত ৯ জুন প্রসব ব্যথা উঠায় রাত ১২টা ৫০ মিনিটে সেন্ট্রাল হসপিটালে ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে মাহবুবা রহমান আঁখিকে ভর্তি করা হয়। যদিও সেই সময়ে সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন না। তারপরও রোগীদের পক্ষ থেকে সংযুক্তা সাহার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, তিনি আছেন এবং অপারেশন থিয়েটারে কাজ করছেন।
ভুক্তভোগীর স্বামী ইয়াকুব আলী জানিয়েছিলেন, তার স্ত্রীকে যখন ওটিতে ঢুকানো হয় এবং নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা শুরু করা হয়, তখনও সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে আছেন কি না জানতে চাওয়া হয়। ওই সময়ও কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি আছেন এবং তিনি তার চেষ্টা চালাচ্ছেন। পরে জানা যায় ডা. সংযুক্তা সাহা ছিলেন না এবং তারা রোগীর কোনোরকম চেক-আপ ছাড়াই ডেলিভারির কাজ শুরু করে দেন।
পরে ওই রাতেই আঁখি সেন্সলেস হয়ে যায়। শেষপর্যন্ত তার কোনো ইমপ্রুভমেন্ট হয়নি। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, তার কোনো ইমপ্রুভমেন্ট হওয়ার সম্ভাবনাও কম। পরবর্তীকালে গত ১০ জুন ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে আঁখিকে ভর্তি করান তার স্বামী ইয়াকুব। এরপর সেন্ট্রাল হাসপাতালে এসে জানতে পারেন তার নবজাতক হাসপাতালের এনআইসিইউতে মারা গেছে।
ভুল চিকিৎসায় শুক্রবার এক নবজাতকের মৃত্যু এবং পরবর্তীকালে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হওয়ার পর সেন্ট্রাল হাসপাতাল নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
এই ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক নির্দেশে বলা হয়েছে, ‘আইসিইউ ও জরুরি সেবার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় অপারেশন থিয়েটারের কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।’ এবং ‘ডা. সংযুক্তা সাহা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লিখিত অনুমোদন ছাড়া পরবর্তী সময়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালে কোনো বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না।’
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, মাহবুবা রহমান আখির পরিবারের কাছ থেকে চিকিৎসাবাবদ নেওয়া সব খরচ ও চিকিৎসাজনিত জটিলতার যাবতীয় ব্যয় সেন্ট্রাল হাসপাতাল বহন করবে। এই ঘটনায় অভিযুক্ত সযুক্তা সাহা লাইভে এসে তার পক্ষে নানা বক্তব্য তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি নির্দোষ এমন বক্তব্যই পাওয়া যাচ্ছে!
মহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মর্মান্তিক মৃত্যুর দায় সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সংযুক্তা সাহা কেউই এড়িয়ে যেতে পারেন না। চাঞ্চল্যকর এই মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হোক। এবং যথাযথ তথ্য-প্রমাণসহকারে অভিযুক্তদের কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
প্রয়াত এই নারী ও তার সন্তানকে অকালে প্রাণ হারাতে হলো এর সব দায় কর্তৃপক্ষের। অভিযুক্তদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। কেউ যেন নতুন ফন্দি এঁটে আইন গলিয়ে বের হতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশে যখন কোনো ঘটনা ঘটে তখন সেটা নিয়ে নানাবিধ মন্তব্য-কাঁদা ছোড়াছুড়ি হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে তা যেমন জনগণ ভুলতে বসে ঠিক তেমনই এর আবহাওয়াও বদলে যায়। এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত-অভিযুক্ত প্রত্যেকেই আইনের আওতায় আনতে হবে।
বর্তমান সময়ে এমন ঘটনা নতুন নয়৷ ভুল চিকিৎসার ফাঁদে পড়ে অনেকেই কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন, কেউবা দীর্ঘস্থায়ী জটিলতায় ভুগছেন আবার কেউবা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করছেন! এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত আর অধিকাংশই থেকে যাচ্ছে পর্দার আড়ালে! সরব কোন ভূমিকা কারোরই নেই। দেশের স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে তাই মানুষের মধ্যে বেশ আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের কোনো উন্নতি আজ অবধি চোখে পড়ছে না। মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মর্মান্তিক মৃত্যুই তা প্রমাণ করে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাতে আর কখনো দেশের মাটিতে না ঘটে এজন্য কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।
সর্বোপরি শোকার্ত পরিবারের জন্য কিছুটা হলেও সান্ত্বনা হবে যদি অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়। এলক্ষে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করা জরুরি। এ ধরনের অপরাধীদের লাইসেন্স বাতিল এবং প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গৃহীত হোক।