Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘নীলিমা ইব্রাহিম’ অকুতোভয় একজন নারী

নারী হওয়া মানেই থাকতে হবে ঘরের চারদেয়ালে বন্দি। থাকতে হবে ঘরের কাজ নিয়েই, থাকবে পরাধীন। কিন্তু এই নারীরা আজ আর থমকে নেই, আটকে নেই ঘরের কাজে। তারাও আজ স্বাধীন জীবনযাপন করছে। নারীর ক্ষমতায়ন বা নারী জাগরণে বাংলার নারীরা বেশ সাড়া জাগিয়েছিলো। তাদেরই একজন হলো নীলিমা ইব্রাহিম। তিনি একাধারে একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক এবং সমাজকর্মী। ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইয়ের মাধ্যমে নারীর সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন ড. নীলিমা ইব্রাহিম। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনেও তাঁর অবদান রয়েছে। মহীয়সী এই নারী শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি- সবকিছুতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন।

নীলিমা ইব্রাহিমের জন্ম ১৯২১ সালের ১১ অক্টোবর বাগেরহাটের মূলঘর গ্রামের এক জমিদার পরিবারে। নীলিমা ইব্রাহিমের বাবার নাম বাবার নাম প্রফুল্ল রায় চৌধুরী এবং মা কুসুম কুমারী দেবী। নীলিমার বাবা পেশায় একজন আইনজীবী ছিলেন। তবে সেই সাথে থিয়েটারের প্রতি তার অগাধ আগ্রহ ছিল। জীবনে বেশ লম্বা সময়ের জন্য খুলনা নাট্য মন্দিরের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। নীলিমা ইব্রাহিমের আসল নাম নীলিমা রায় চৌধুরী। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন নীলিমা ইব্রাহিম। চারটি বিষয়ে লেটার নিয়ে খুলনা করোনেশন গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতার ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউট থেকে আইএ এবং কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএবিটি শেষ করেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ও সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাস করেন।

শিক্ষাজীবন শেষ হলে লরেটো হাউজ এবং ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউটে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেও শিক্ষকতা করেছেন নীলিমা ইব্রাহিম। ১৯৪৫ সালে নীলিমা প্রথম নারী হিসেবে বিহারীলাল মিত্র বৃত্তি লাভ করেন। প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ১৯৪৫ সালে পারিবারিক জীবনে প্রবেশ করেন নীলিমা ইব্রাহিম। তৎকালীন ইন্ডিয়ান আর্মি মেডিকেল কর্পসের ক্যাপ্টেন ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। আর বিয়ের পরেই তিনি নীলিমা রায় চৌধুরী থেকে নীলিমা ইব্রাহিম হয়ে যায়। নীলিমা ইব্রাহিম ১৯৫৯ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট শেষ করেন তখন তিনি পাঁচ কন্যার জননী- খুকু, ডলি, পলি, বাবলি ও ইতি।

বাবার থিয়েটারের প্রতি আগ্রহ থাকায় নীলিমা ইব্রাহিমও থিয়েটারের প্রতি ছোটবেলা থেকেই দুর্বল ছিলেন। পরবর্তীতে কালের আবর্তনে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার সুযোগ হয়, তখন গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটক’ স্থির করেন। নীলিমা তাঁর গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে দুটি বইও লিখেছেন। এগুলো হলো- ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা বাঙালি সমাজ ও বাংলা নাটক’ এবং ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘বাংলা নাটক: উৎস ও ধারা’। সাহিত্যচর্চায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও রেখেছেন মহীয়সী এই নারী। নাটক ও উপন্যাস উভয় বিষয়ে লিখেছেন একাধিক লেখা। তাঁর রচনায় ফুটে উঠেছে সামাজিক বৈষম্য ও নারীর অধিকারের কথা। নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারটি হলো- দুয়ে দুয়ে চার (১৯৬৪), যে অরণ্যে আলো নেই (১৯৭৪), রোদ জ্বলা বিকাল (১৯৭৩) এবং সূর্যাস্তের পর (১৯৭৪)। ‘দুয়ে দুয়ে চার’ এবং ‘রোদ জ্বলা বিকাল’-এর মূল আলোচ্য বিষয় সামাজিক বৈষম্য। ‘যে অরণ্যে আলো নেই’ ছিল একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক যেখানে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে আসলে মুক্তিযুদ্ধের সময় যৌন নির্যাতনের শিকার সেই নারী নিজের পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। নীলিমার লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশ শতকের মেয়ে (১৯৫৮), এক পথ দুই বাঁক (১৯৫৮), কেয়াবন সঞ্চারিণী (১৯৬২) এবং বহ্নিবলয় (১৯৮৫)। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন এবং কিছু বিদেশি বই অনুবাদও করেছেন।

‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ নামক বইটি নীলিমা ইব্রাহিমের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কালজয়ী গ্রন্থ। নীলিমার এই বই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এই দেশের নারীদের উপর যে অমানবিক ও পাশবিক নির্যাতন করা হয় সেসবের একটি প্রামাণ্য দলিল। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার সকল নারীর সঙ্গে কথা বলে তাঁদের নারকীয়, বর্বর অভিজ্ঞতা টুকে রাখতেন দিনপঞ্জিতে কোন সমাজের পরোয়া না করে, ভয় না করে। তিনি এই গ্রন্থটি জনসমাজে এসকল বীরাঙ্গনার মন-মানসিকতা, নিপীড়ন এবং নির্যাতনের বাস্তব কাহিনী তুলে ধরার প্রচেষ্টায় প্রকাশ করেন।

নীলিমা ইব্রাহিম ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। সেই সময়ে বাংলাদেশে তথা পূর্ব বাংলায় সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে পাকিস্তানি বাহিনীর শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করে। এ সময়ে পাঠদানের পাশাপাশি নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়েন মহীয়সী নারী। ১৯৬১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পালনে পাকিস্তানি বাহিনী বাধা দিলে তিনি প্রত্যক্ষভাবে এর বিরোধিতা করেন এবং ১৯৬৪ সালে দাঙ্গা হলে সাধারণ জনগণের সহায়তায়ও এগিয়ে যান। স্বাধীনতা লাভের পূর্বে তিনি প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সেই সময়ের অনেক ছাত্রনেতাকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ দায়িত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাবার এবং অর্থ দিয়ে সাহায্য করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন।

মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। এই বোর্ডের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন নীলিমা ইব্রাহিম। এই পুনর্বাসন বোর্ডে যুক্ত হওয়ার সুবাদে এবং ১৯৭২ সালে পাকিস্তানি বন্দীদের সাথে দেশত্যাগ করা ধর্ষণের শিকার কিছু নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাওয়ায় নীলিমা তাদের উপর চালানো মর্মান্তিক নির্যাতনের কথা জানতে পারেন। এরপরেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নীলিমা ইব্রাহিম। তিনি বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন এবং সমাজকল্যাণমূলক ও নারীর উন্নয়ন বিষয়ক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথেও জড়িত ছিলেন।

নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন একজন অকুতোভয় নারী, যিনি কখনও সত্যের সাথে আপোষ করেন নি। নারীর কথা তুলে ধরার চেষ্টা বরাবরই করেছেন। সবসময় নারীর পাশে দাঁড়িয়ে নারী জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। তাঁর এসব কাজের জন্য তিনি নানান পুরষ্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এগুলো হলো- বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), জয় বাংলা পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার (১৯৮৭), লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৯), বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্মৃতি পদক (১৯৯০), অনন্যা সাহিত্য পদক (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), বঙ্গবন্ধু পুরস্কার (১৯৯৭), শেরে বাংলা পুরস্কার (১৯৯৭), থিয়েটার সম্মাননা পদক (১৯৯৮) এবং একুশে পদক (২০০০)।

অকুতোভয় নারী ড. নীলিমা ইব্রাহিম ২০০২ সালের ১৮ জুনে ৮১ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান।

অনন্যা/এসএএস

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ