রাষ্ট্রকেই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে
বর্তমান সমাজে মানুষ দিন দিন হিংস্রতার চরম শিখরে অবস্থান করছে! মানুষ হয়ে প্রতিনিয়ত আরেকজন মানুষকে অনিরাপদ করে তুলছে তারা। মানব সমাজ সংঘবদ্ধ হয়েছিল, রাষ্ট্র বা সমাজ গড়ে তুলেছিল একে অপরের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য। কিন্তু দিনকে দিন মানুষ হিংস্র হয়ে উঠছে। মানুষের এই অতি দানবীয় কার্যক্রমের শিকার বিশেষভাবে এ সমাজের নারীরা। সমাজে প্রতিনিয়তই নারীর সঙ্গে দুর্বিষহ ঘটনা ঘটছে। কোনো নারীই নিরাপত্তা বোধ করেন না। এমন একটা সময়ে আমরা বাস করছি যেখানে নারীরা ঘরে অবস্থান করেও অতি সংকট ও সংকোচে জীবনযাপন করছেন। তাহলে আর কোথায় নারীর নিরাপত্তা?
সময়ের সঙ্গে মানুষ সভ্য-ভব্য হয়। মানুষের বিবেকবোধের সঞ্চার ঘটে। কিন্তু এ সমাজ পচে-গলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। মানবিকতাবোধের লেশমাত্র এখানে আর নেই। কন্যাশিশু থেকে প্রাপ্ত বয়সের নারী এমনকি অতি বৃদ্ধাও অনিরাপদ। এক দানবীয় শক্তিতে ভর করে দুর্বৃত্ত ও অসাধু-কুচক্রীমহল নারীদের গ্রাস করে চলেছে! একটি করে ঘটনা সামনে আসে আর রক্ত হিম হতে থাকে! এ সমাজে সত্যি নারীদের মাথাগোঁজার নিরাপদ ঠাঁই কোথায়! ঘরেও যদি মেয়েরা নিরাপদ না থাকে তবে আর কোথায় মিলবে নিরাপত্তা? নাকি নারীদের পৃথিবীর বাস উঠিয়ে কোনো মঙ্গলগ্রহের বাসিন্দা হতে হবে! যেখানে পুরুষের হিংস্রতা থাকবে না! যৌন হয়রানি, গুম, খুন, ধর্ষণ থাকবে না! সত্যিই নারীদের নিরাপত্তা আর কোথায় মিলবে!
গণমাধ্যম বরাত জানা যায়, ৮ সেপ্টেম্বর বগুড়ায় মাদ্রাসাপড়ুয়া ১৬ বা ১৭ বছর বয়সী এক মেয়ের ওপর বর্বরোচিত নিপীড়ন চালানো হয়। বাড়িতে একা ছিল সে। সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে এক দুর্বৃত্ত কোনোভাবে বাড়ির ভেতরে ঢুকে তার ওপর নির্যাতন চালায়। মেয়েটির গলায় চাপ দিয়ে ধরলে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। এবং মরে গেছে ভেবে আশপাশে থাকা চটের বস্তা ও কাপড় দিয়ে তার শরীর ঢেকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতেই দাউ দাউ করে আগুনের আঁচে মেয়েটির জ্ঞান ফিরলে দৌড়ে পাশের বাড়িতে এক আত্মীয়ের কাছে গিয়ে আসামির নাম উল্লেখ করে ঘটনার কথা জানায়। মেয়েটির শরীরের ২৪ শতাংশ পুড়ে গেছে। এখন সে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে!
সংবাদমাধ্যম বরাত আরও জানা যায়, মেয়েটির অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। তার ডান হাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া বুক, পিঠ, স্তন, পাসহ শরীরের যেসব জায়গা পুড়েছে, সব জায়গায়ই গভীর ক্ষত হয়েছে। আপাতত তার পুরো ডান হাত কেটে ফেলতে হবে না। ডান হাতের বুড়ো আঙুল ও তর্জনী কেটে ফেলতে হবে। মেয়েটির শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে অস্ত্রোপচার (স্কিন গ্রাফট) করতে হবে। রক্তস্বল্পতা থাকায় তাকে রক্ত দিতে হচ্ছে। ঘটনার দিন মেয়েটির মা–বাবা বাড়িতে ছিলেন না। সেদিন ছিল শুক্রবার। দুপুরে মেয়েটির দাদি নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিলেন। এই ফাঁকে তার ওপর হামলে পড়েছিল ওই দুর্বৃত্ত।
মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে কিছু বলেনি তার আত্মীয়-স্বজন। ঘটনার পর থেকে মেয়েটি ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে আছে। তাই মা নিজেও মেয়ের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাননি। তবে গলায় এত জোরে আসামি চাপ দিয়ে ধরেছিলেন যে মেয়ে কোনো কিছু খেতে পারছে না। মেয়েটির শরীর পোড়েনি, এতটুকু জায়গা খুঁজে পেতেও কষ্ট করতে হবে বলেই জানিয়েছেন তার পরিবারবর্গ!
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে যে ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকার মেয়েটির কথা উল্লেখিত হয়েছে তাতে করে এ সমাজে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে বিশদ প্রশ্ন উঠছে! একটি মেয়ে তার বাড়িতেও নিরাপদ নয় তাহলে সে কোথায় নিরাপদ? দুর্বৃত্ত, ধর্ষণকারী ও নিপীড়নকারীদের এতটা সাহস কোথা থেকে পাওয়া? তাদের প্রাণের মায়া নেই নাকি তারা আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে বলেই তাদের এত স্পর্ধা? প্রকৃত সত্য কী! আর কেনোই বা এ সমাজে মেয়েরা দিন দিন আরও অনিরাপদ হচ্ছে?
সমাজে নারীরা যতোটা অগ্রসর হচ্ছে ঠিক ততোটাই তারা অনিরাপদ। রাস্তা-বাসে-ট্রেনে কোথায় নারী নিরাপদ? আজকাল ঘরেও নারীকে ধর্ষণ-খুন-গুমের শিকার হতে হচ্ছে! এই ছোট্ট মেয়েটির যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তার দায়ভার কার? এ সমাজ-রাষ্ট্র কি সত্যি এর দায় এড়াতে পারবে! কীভাবে তার ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেবে এ রাষ্ট্র আর অন্যান্য নারী-কন্যাশিশুরাই বা কীভাবে সমাজে নিরাপত্তা পাবে! আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকতে হয় সব নারীদের তাদের সঙ্গে কোথাও যদি এমন ঘটনা ঘটে! জীবনের অনিরাপত্তা নিয়ে কীভাবে আগামী দিনে পথ চলবে নারী? কোথায় নিরাপত্তা! কোথায় নারীর স্বাভাবিক জীবন! সমাজে নারীর প্রতি এতো আক্রোশ কেনো! পুরুষতান্ত্রিকতার অবসান কি আদৌ এ সমাজে হবে না?
প্রশ্নগুলোর উত্তর এ সমাজ-রাষ্ট্রের কাছে পাবে কি নারীরা। এ সমাজে এমন অনিরাপদ জীবন নিয়ে নারীদের এগিয়ে চলা কীভাবে সম্ভব? আর কোনো মেয়ের যেন এমন সংকোটের মধ্যে দিয়ে জীবন পার না করতে হয় এলক্ষে রাষ্ট্রকে কঠোর হুশিয়ারি দিতে হবে। কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই হয়তো সমাজে অপরাধ কমবে। সেইসঙ্গে দীর্ঘসূত্রিতাও বন্ধ করতে হবে। নারীদের ওপর অত্যচার হলে কোনো গাফিলতি না করে উপর্যুক্ত তথ্য-প্রামণের সাহায্যে অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। মেয়েটির ওপর যে নিপীড়ন চালানো হয়েছে একমাত্র সুষ্ঠু বিচার ও ক্ষতিপূরণে কিছুটা হলেও ক্ষতটা শুকাতে সাহায্য করবে। যদিও মেয়েটির জীবনের যে অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে তা কখনোই পোষাবার নয়। তবু পিতা-মাতার কাছে একটা সান্ত্বনার বাণী হয়তো থাকবে। তাই দ্রুত মেয়েটির সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের প্রতি শাস্তি নিশ্চিত হোক। আর নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনোর কঠোরতা ও তৎপরতা গড়ে উঠুক।