অন্যায়ের কাছে মাথা নত করো না নারী
আমাদের সমাজে নারীর সঙ্গে প্রতিনিয়তই অন্যায়-অত্যাচার-নিপীড়ন চলছে। অধিকাংশ নারী নির্যাতন নিয়ে মুখ খোলে না। মূলত পারিবারিক মান-সম্মান, ভালোবাসাজনিত কারণে, চাকরি যাওয়ার ভয়, নিপীড়নের শিকারে পরিণত হওয়া, হামলা-মামলা, সম্পর্কের অবনতি, ডিভোর্স নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে নারীরা মুখ বুজে থাকে। যা সত্যি তা সবার সামনে তুলে ধরতে ভয় পায়। এমনকি অনেক নারী দিনের পর দিন এসব সহ্য করেন নীরবে। যন্ত্রণা অতিরিক্ত হলে বেদনায় মুষড়ে পড়ে, আত্মহননের চেষ্টা করে! কিন্তু নারীদের উচিত নিজের অবস্থান অনুযায়ী অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। মিথ্যা ভয়ে মাথা নত না করা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের ‘ন্যায়দণ্ড’ কবিতায় বলেছিলেন, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।’ অন্যায়কারী ও অন্যায় সহ্যকারী দুজনেই সমান অপরাধী, যদি প্রতিবাদ না করে! যুগের পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু নারীর জীবন আজও রয়ে গেছে নিকষ অন্ধকারে! অনেক নারী আজও মুখ বুজে নীরবে সবকিছু হজম করে। শত অন্যায় শোষণের কোনোই প্রতিবাদ করে না। বরং চুপ থেকে কষ্ট পায়।
পরিবার থেকে শুরু হয় নারীর প্রতি অবিচার। অধিকার বলে নারীর ওপর একের পর এক অন্যায় আবদারও চাপিয়ে দেওয়া হয়। তখন নারীকে চুপ করে সহ্য করে নিতে হয়। কারণ তারা রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত! পড়াশোনা, চলাফেরা, প্রেম, দাম্পত্য কোথাও নারীর নিজস্ব মতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না!
বাবা-মা বা পরিবারের কর্তাদের কথা অনুযায়ী একজন নারীকে তার ভবিষ্যৎ জীবনে এগুতে হয়। নারী এর প্রতিবাদে অক্ষম কারণ তারা পরমাত্মীয়। বাবা-মায়ের গণ্ডি পেরিয়ে যখন একজন নারী স্বামীর ঘরে যায়, তখন শুরু হয় আরেক শোষণ! শ্বশুর-শাশুড়ি-স্বামী সবার মতো অনুযায়ী নারীকে তার জীবনের পথে চলতে হয়। পরিবারের শৃঙ্খলা বজায়ে মত নেওয়া দোষের কিছু না কিন্তু মতটা যদি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন তা অবশ্যই দোষের! কারণ প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন। আর স্বাধীন মানুষের চলার পথ রুদ্ধ করা অন্যায়। তিনি যে সম্পর্কেই আবদ্ধ হোন না কেন। পরিবারের সম্মান, মর্যাদা, ঐতিহ্য রক্ষার্থে অধিকাংশ নারী আজও পারিবারিক নিপীড়ন সয়ে যায়। কিন্তু নীরবে সয়ে যাওয়া মানে মেরুদণ্ডহীনতার পরিচয় দেওয়া। সেইসঙ্গে অন্যায়কারীকে আরও অন্যায় করতে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই পরিবার থেকে যদি নারীর প্রতি কোনো রকম সহিংস আচরণ করা হয়, তবে নিজের আত্মরক্ষার স্বার্থেই প্রতিবাদই হতে পারে নারীর একমাত্র হাতিয়ার।
বর্তমানে পারিবারিক সহিংসতার পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু নারীদের নীরব ভূমিকা তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালাতে আরও উদ্যোগী করছে পুরুষতন্ত্রকে। নারীরা যদি অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী না হন, তবে নারীদের এই ভয়াবহতার হাত থেকে রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব। তাই যেখানে অন্যায় সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে।
বাল্যবিয়ে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ কিন্তু কিছু পরিবার নিজেদের অজ্ঞানতা এবং অক্ষমতা বশত কন্যা সন্তানের অপরিণত বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে নারীরা যদি নিজেরা প্রতিবাদ না করে তবে সরকারের একার পক্ষে শতভাগ বাল্যবিয়ে রুখে দেওয়া সম্ভব হবে না। তাই নারীর প্রতি অন্যায় হলে আগে নিজেকেই আওয়াজ তুলতে হবে। বর্তমানে প্রশাসন তৎপর। তাই নারীর প্রতিবাদে যদি অপরাধীরা দমে না যায়, তবে আইনি সহায়তা নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি পদক্ষেপ অনুযায়ী ৯৯৯ -এ সব ধরনের সেবা পাওয়া যায়। সব নারীকে প্রতিবাদের এ ভাষা রপ্ত করতে হবে নতুবা নিপীড়নকারীদের দমানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।
সামাজিক অবক্ষয় ইভটিজিং, ধর্ষণ এগুলোরও মোক্ষম হাতিয়ার হতে পারে প্রতিবাদ। কিন্তু বেশিরভাগ ভুক্তভোগী নারী ঝামেলা পোহাতে চায় না বলে আইনের সহযোগিতা নেয় না। এমনকি মৌখিক প্রতিবাদটুকুও করে না। কারণ সমাজ তো একবাক্যে নারীকে সর্বদা দোষ দিতে প্রস্তুত। ঘটনা কেন ঘটলো, কী ঘটেছে, তার বিচার একটাই, নারী দোষী।
তবে, এভাবে আর বেশিদিন চলতে দেওয়া যায় না। নারীর কণ্ঠস্বর হোক উচ্চকিত। সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে নিজেই নিজের শক্তি হয়ে উঠুক। রবীন্দ্রনাথের ‘একলা চলো’ নীতিই হোক নারীর নীতি। তবুও নারী আপন প্রতিবাদে আপনার অধিকারটুকু রক্ষা করুক। অন্যায়কে না বলতে শিখুক। অন্যায় হলে সেখানে মুখ বুজে সহ্য না করে সামনাসামনি মোকাবিলা করার সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করুক।
বর্তমানে গণ-পরিবহনে নারীকে বেশিরভাগসময়ই বিভিন্নভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয় সেখানেও নারীর প্রতিবাদই তাকে রক্ষা করতে পারে। কথায় আছে শক্তের ভক্ত নরমের জম। তাই নারীকে শক্তি নিয়ে চলতে হবে। সব বাধা একা পার করার ক্ষমতা যতদিন নারী গ্রহণ না করবে, ততদিন সমাজের অন্যায় চলতেই থাকবে। কারণ পুরুষতন্ত্র নারীকে দুর্বল ভেবে আসছে আজও! তাই নারী যে দুর্বল কোনো জড়বস্তু নয় বরং রক্ত-মাংসের বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ, তা নারীকেই প্রমাণ করতে হবে।
বর্তমানে পত্র-পত্রিকায় দেখা মেলে কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা! এক্ষেত্রেও নারীরা অধিকাংশ সময় মানসম্মান বা চাকরি হারানোর ভয়ে মুখ বুজে সহ্য করে। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা যেখানে নেই, সেখানে অন্যায়টা আরও প্রকট আকার ধারণ করে! তাই পরিবার হোক বা সমাজ বা কর্মক্ষেত্র কোথাও নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচারকে প্রশ্রয় দেওয়া অন্যায়। একমাত্র প্রতিবাদই হতে পারে যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে মুক্তি পেতে নারীর মোক্ষম হাতিয়ার।
রাজনৈতিক মাঠে-মঞ্চে-সভায়-জীবন চলার পথে নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠুক দৃপ্ত-দীপ্তকণ্ঠে। নারী যদি অন্যয়ের বিরুদ্ধে মুখ না খোলে, তবে তার প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায় বাড়বে বৈ কমবে না। তাই যেখানে অন্যায়, সেখানে নারীর প্রতিবাদ হোক ঝাঁজালো। নারী গর্জে উঠুক অন্যায়কে রুখে দিতে। কারণ এ পৃথিবীতে কেউ কারো নয়। তাই প্রয়োজন যেহেতু নারীর ফলে নারীকেই প্রতিবাদ করতে হবে। প্রয়োজনবোধে আইনী সাহায্য- সহোযোগিতা গ্রহণ করতে হবে।