আধুনিক কৃষ্ণকলি
‘কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ। কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি’, মেঘলাদিনে ময়নাপাড়ার মাঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে মেয়ের কালো হরিণ চোখের দেখা পেয়েছিলেন, তারই নাম দিয়েছিলেন কৃষ্ণকলি। শ্যামলবরণ মেয়েটিকে অন্য লোকে হয়তো ‘কালো’ বলতে পারে। তবে কবির চোখে সে কৃষ্ণকলি। কবিগুরু যাই বলুন, এই সমাজে সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। এমনকি ডিজিটাল যুগের শিক্ষিত ছেলেরা এই যুগেও শিক্ষাগত যোগ্যতাকে সুপাত্রী তালিকার নিচের দিকে রেখে গায়ের রংকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন! মাড় দেওয়া কোচকানো চওড়া পাড়ের তাঁতের শাড়ি, খোঁপায় তার বেলীফুলের মালা জড়ানো, হাতভর্তি রঙিন কাচের চুড়ি আর কপালে উজ্জ্বল টিপ। কল্পনার এমন সুন্দর, সজ্জিত চিরায়িত নারীর ভিড়ে আধুনিকার রং যদি হয় কালো? চিন্তা হোক সুন্দর। শ্যামবরণ মেয়েটিও কিন্তু পোশাক, সাজ, ফ্যাশন নিয়ে হয়ে উঠতে পারেন আকর্ষণীয়। আধুনিক কৃষ্ণকলিকে দেখে বিমোহিত হতে পারেন হাল যুগের রোমিওরা!
পোশাকে হোন আধুনিক
পার্টিতে যাবেন। কিন্তু ওয়ার্ডরোবের সামনে দাঁড়িয়ে কোন রঙের পোশাক পরবেন ভাবতে ভাবতেই মুডটা অফ হয়ে গেল? মানছি, আপনার গায়ের রং কালো। কিন্তু ভাবুন তো, ¯্রফে গায়ের রং কালো বলে মুড অফ করে বসে থাকবেন? নাকি শপিংমলে গিয়ে রং-বেরঙের জামাকাপড় দেখে ট্রাই করার কথা ভাবলেই মেজাজ গরম হয়ে যায়? ভাবেন নিশ্চয়ই যে আপনার গায়ের রং কালো বলে কোনো রঙের পোশাকই আপনাকে মানাবে না? আপনার মন খারাপের দিন এবার শেষ। গায়ের রং কালো ঠিক আছে, কিন্তু কে বলে আপনার হরেক রঙের পোশাক পরে সাজতে নেই! ফ্যাশন ডিজাইনার শাহীন আহ€ে§দ জানালেন, চাপা রঙের মেয়েদের পোশাকে গাঢ় হলুদের ছোঁয়া থাকলেও অসুবিধা নেই। চাইলে সবুজ বা কমলা রঙের পোশাকও পরা যেতে পারে। ডিজাইনার অর্পিতা সমাদ্দার বলেন, গায়ের রং চাপা হলে সবচেয়ে ভালো মানায় বিভিন্ন শেডের গাঢ় গোলাপি রং। ম্যাজেন্ডা, হলুদ, মেরুন বা বেগুনি রঙের পোশাকও পরা যেতে পারে। কালো রঙের পোশাকেও তাদের মানিয়ে যায় বেশ। অফ হোয়াইট কিংবা নিয়ন রঙের পোশাকও তারা পরতে পারেন অনায়াসে। আর পোশাকে হালকা কাজ বা ভারি কাজ যা-ই থাকুক না কেন, রং মানিয়ে গেলে সেই পোশাক তারা পরতে পারেন নিশ্চিন্তে। এসব বিষয় মাথায় রেখে যে-কোনো পোশাকই পরে নিতে পারেন আজকের কৃষ্ণকলিরা। তবে প্যাটার্ন ভিন্নতার পাশ্চাত্য ও দেশি কাটের ফিউশন পোশাক পরতে হলে প্রাধান্য দিন আপনার ব্যক্তিত্ব এবং শারীরিক অবকাঠামোকে।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
জন্মে দেখেছি ঘরের দেয়াল, আসবাব, বিছানা-চাদর সবই রঙিন। শুধু রং নেই স্বজনদের চোখে, আমার কৃষ্ণবর্ণ কালো করে দিয়েছে তাদের মুখ।
আর তাদের কড়া দীর্ঘশ্বাস আমার নিশ্বাসকে করে দিয়েছিল অকাল শ্রাবণের মতো অন্ধকার, যে শ্রাবণের জলে উৎসব ভাসে নাÑসমাজের অধিকাংশের মানসিক অবস্থান নিয়ে এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতার জানান দিচ্ছিলেন নাজনিন তিথি। বাংলালিংকের টেলিসেলসের এই কর্মকর্তা জানান, গায়ের রং কালো বলেই তার বাবা তাকে জন্মের পর দেখতে আসেননি দুই মাস!
আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষ এখনো সুন্দরী বলতে দুধে-আলতা গায়ের রং বুঝে থাকেন। গায়ের রং শ্যামবর্ণ হলে কেন জানি কেউ সেই মেয়েকে আর যাই বলুক সুন্দরী বলেন না। হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো যখন পড়তাম তখন খেয়াল করেছি যে, প্রায় সব বইতেই রূপবতী মানেই ফরসা আর মায়াবতী মানেই হলো শ্যামবর্ণের মেয়ে! হয়ত মেয়েদের সৌন্দর্যের এই ক্যাটাগরি তিনি করেছেন আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আক্ষেপ করে বললেন তিথি! শুধু লেখকেরা কেন, মেয়েদের রং ফর্সা করার ক্রিমের বিজ্ঞাপনগুলোতে মডেলদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন গায়ের রং ফর্সা নাহলে মেয়ের বিয়ে হবে না, চাকরি হবে না, জীবনে কেউ ফিরে তাকাবে না। অথচ এই কনসেপ্টের বিজ্ঞাপনগুলো দিয়ে শ্যামবর্ণের মেয়েদের যে হিউমিলিয়েট করা হচ্ছে তা গুরুতর অপরাধের শামিল।
আরো মজার ব্যাপার হলো, পাত্রী সুন্দরী হতে হবে এটা বলার পর প্রায় সব পাত্রই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছেন, পাত্রীর ফ্যামিলিটাও নাকি ভালো হওয়া চাই। কেমন ভালো, জানতে চাইলে বলেছেন এই মানে সচ্ছল হলেই চলবে। তার মানে, সেটেল্ড ম্যারেজের ক্ষেত্রে পাত্রপক্ষের কাছে সুপাত্রীর প্রথম নির্ণায়ক হলো ফর্সা এবং দ্বিতীয় হলো টাকা-পয়সা!
অন্যদিকে আমার পরিচিত অনেক মেয়েকেই জানি, যারা পড়াশোনায় অত্যন্ত ভালো, মার্জিত। শুধু গায়ের রং কালো হওয়ার কারণে যোগ্যতাস€úন্ন পাত্রকুল তাদের বিয়ে করতে অনাগ্রহী। তবে পাত্রী শুধু গায়ের রং সাদা হওয়ার কারণে বিয়ের বাজারে অত্যন্ত কাক্সিক্ষত হয়ে ওঠেন।
– ছবি : ফ্রিডম্যান কিন্নাত চৌধুরী
-সাজসজ্জা: ফাতেমাতুল মনীষা,