ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম: দিন কেটে যায় ঘুমিয়ে
অস্বাভাবিক এক রোগের নাম ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম। এই রোগে আক্রান্তকারীরা দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে কাটান। দিনের প্রায় ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টা কিংবা তার চেয়েও বেশি সময় বিছানায় ঘুমিয়ে কাটতে পারে। তা ছাড়াও অত্যধিক ক্ষুধা, ব্যবহারের পরিবর্তন ইত্যাদিও দেখা যায় ভুক্তভুগির মধ্য।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম হাতেগোনা অল্প সংখ্যক রোগীর দেহে পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতকের ফরাসি চিকিৎসক ডি বুশ্যানে সর্বপ্রথম ২৪ বছর বয়সী এক তরুণীর কথা বর্ণনা করেছেন, যেখানে তিনি প্রায় সময় ২০-২২ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটাতেন। ডি বুশ্যানে বলেন, এই দীর্ঘ সময় ঘুমের বিপত্তি একদিন থেকে আট দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল এবং এরকম অন্তত চারবার ঘটেছিল।
তবে বিষয়টা তখনো গবেষকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে পারেনি। কেননা ১৯২৫ সালের দিকে উইল ক্লেইন নামে এক স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ এরকম পাঁচজন রোগী খুঁজে পান। ফ্রাঙ্ক ফুর্টের অধ্যাপক ক্লেইস্টের ক্লিনিক থেকে এদের শনাক্ত করেন। এরা সকলে প্রায় অতিরিক্ত সময় ঘুমিয়ে কাটাতো, যা স্বাভাবিক কোনো কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না।
ক্লেইনের চার বছর পর নিউ ইয়র্কের সাইকিয়াট্রিস্ট ম্যাক্স লেভিনও অতিরিক্ত ঘুমের সমস্যার রোগীদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। কিছু রোগীর কথা ১৯৩৬ সালে প্রকাশ করেন, যেখানে ক্লেইনের একজনসহ মোট পাঁচজন রোগীর ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ঘুম এবং ক্ষুধার যৌথ লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪২ সালে স্নায়ুরোগ বিশারদ ক্রিচলি আর হফম্যান ক্লেইন আর লেভিনের গবেষণাকে আরো বিষদ আকারে করার কথা ভাবেন। তাদের নামানুসারে এই রোগের নাম ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম প্রস্তাব করেন তারাই। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ক্রিচলি ক্লেইন লেভিনের বলা রোগী বাদেও আরও পনেরজন খুঁজে পান। নিজে শনাক্ত করেন ১১ জনকে। রোগীদের অনেকেই ছিল ব্রিটিশ মেরিন সেনা, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করেছিল। এরপর হফম্যানের সাথে মিলে এদের পর্যবেক্ষণ করেন তিনি।
ক্রিচলি আর হফম্যান দুই তরুণের কথা লিপিবদ্ধ করেন, যাদের ক্ষেত্রে কয়েক সপ্তাহের জন্য ঘুম আর খাওয়ার সমস্যা দেখা দিতো। এরপর সব ঠিক হয়ে যায় তবে কয়েক মাস পর আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় সমস্যা শুরুর কয়েকমাস আগে তারা কোনো সংক্রমণে ভুগছিলেন। তবে অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই তেমন কিছু দেখা যায়নি।
ক্রিচলি আর হফম্যানের মত করেই পরবর্তী দশকগুলোতে ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম নিয়ে অনেক গবেষক আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এবং ১৯৯০ সালে স্লিপ ডিজঅর্ডারসের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই রোগকে, এর কিছু চিহ্নও নির্দিষ্ট করেন গবেষকেরা। চিকিৎসা সাহিত্যে এখন পর্যন্ত ৫০০টি ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোমের উল্লেখ পাওয়া গেছে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এই রোগ শনাক্তকরণ খুব একটা সহজ নয়, ফলে অনেক রোগীই জানেন না তারা এই রোগে আক্রান্ত। সাধারণত কিশোর বয়সে রোগের উপদ্রব দেখা দেয়, যা ছেলেদের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যায় ।
লক্ষণ
যদিও ঠিক কী কারণে রোগের সূচনা তা অজানা, তবে অনেক ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী কোনো ধরনের সংক্রমণের ইতিহাস থাকতে পারে। রোগের প্রকোপ দেখা যায় বিচ্ছিন্নভাবে, মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে রোগী সম্পূর্ণ লক্ষণযুক্ত এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন।
ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোমের রোগী একবারে ১৮-২০ ঘণ্টায় ঘুমিয়ে কাটান কিংবা তারও বেশি সময় পর্যন্ত। যখন রোগের প্রকোপ দেখা দেয়, তখন কেবল খাওয়া আর প্রাকৃতিক কার্য সারা ব্যতীত অন্য কোনো কারণে ঘুম থেকে ওঠেন না তারা।
অনেকেই প্রশ্ন করতেই পারেন, তাদের কি ডেকে তোলা সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব, তবে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয় বা হবে। কারণ, জোর করে তোলা হলে তাদের মধ্যে অস্থিরতা, আক্রমণাত্মক মনোভাব, অবসাদ, কনফিউশন ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে কথা জড়িয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে না ডাকায় শ্রেয়।
আরেকটি উপসর্গ থাকে অতিরিক্ত ক্ষুধার, যা ঘুমের পাশাপাশি দেখা দেয়। রোগীরা অন্যান্য সময়ের থেকে অস্বাভাবিক বেশি পরিমাণে খেতে শুরু করেন। মিষ্টি খাবার পছন্দ করলেও খুব একটা বাদবিচার এসময় করেন না তারা। যা পায় তাই খায়। আরেকটি সমস্যা হয় যৌন প্রবৃত্তিতে। অন্যান্য সময় স্বাভাবিক মানুষটি অতিরিক্ত জৈবিক চাহিদা প্রদর্শন করতে শুরু করেন। তাদের কথাবার্তা আর আচার-আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে যায়।
মনে রাখতে হবে, সব রোগীর মধ্যে তিনটি উপসর্গ থাকার সম্ভাবনা খুব কম। অধিকাংশ সময় এক-দুটি লক্ষণ থাকতে পারে। পাশাপাশি উগ্র আচার-ব্যবহার প্রদর্শন করে রোগী। ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোমের রোগীরা শরীরের পাশাপাশি মানসিক অবসাদে ভোগে। ফলে অনেকটা একাকী থাকতে পছন্দ করে তারা। এজন্য অনেক সময় তাদের মানসিক রোগী বলে ভুল হতে পারে। একটা বড় ব্যাপার হলো সারাক্ষণ উপসর্গগুলো থাকে না। বছরে ২-১২ বার হতে পারে, প্রতিবার এক থেকে তিন সপ্তাহ থাকতে পারে সমস্যা। এরপর আবার সব ঠিক।
প্রতিকার
অনেক সময় দেখা যায় বয়স বাড়ার সাথে সাথে একাই ঠিক হয়ে যায় সবকিছু। তবে বাকিদের ক্ষেত্রে বিরতি দিয়ে এই বিপত্তি চলতে থাকে। যেহেতু নির্দিষ্ট কারণ আবিষ্কৃত হয়নি এখনও, তাই চিকিৎসা করা হয় উপসর্গভেদে। এজন্য বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠন করতে হয় মেডিকেল বোর্ড। রোগীর পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হয় পুরো প্রক্রিয়াতে।
ওষুধ দিয়ে খুব একটা উপকার পাওয়া যায়না ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোমে, বরং জীবনযাপন প্রণালীতে কিছু পরিবর্তন আনার ওপর জোর দেয়া হয়। যখন রোগের প্রকোপ চলতে থাকে তখন রোগীকে সম্পূর্ণ ভাবে ঘরে বসে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম যদিও জীবননাশের কারণ নয়, তবে নানাভাবে রোগীর জন্য বিব্রতকর হতে পারে তা। কাজেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া বেশ জরুরি।