নারী সেলিব্রেটি হলেও তার জীবন নিয়ে ট্রল নয়
সৃষ্টির যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
-কাজী নজরুল ইসলাম
সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত সভ্যতার অগ্রগতিতে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। প্রীতিলতা থেকে সুফিয়া কামাল কিংবা কামিনী রায় থেকে কুসুমকুমারী দেবী, তারাও ছিলেন নারী। সমস্ত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে কেউ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন দেশ রক্ষায়, তো কেউ অবদান রেখেছেন সাহিত্যে। নারী শব্দটির আক্ষরিক অর্থ-ই হলো মানবী, মনুষ্যা, রমণী, নন্দিনী, অপরাজিতা।
পুরাণে তো ‘মানুষ’ নারী খুঁজে পাওয়া ভার। পুরাণে নারী ছিলেন দেবী। সীতা, কুন্তী, শকুন্তলা তাঁদের দেবীরূপে দেখা হতো। বর্তমানে নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয় না। মহাভারতে দ্রোপদীকে সাহায্য করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থাকলেও বর্তমানে নারীদের জন্য আইন যেন নিষ্ক্রিয়। আগে একজন নারী অন্দরমহলের বাসিন্দা থাকতো। কিন্তু বর্তমানে নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছে। আজ নারীদের কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিক্ষক কেউ বা অভিনয়শিল্পী। আর সেলিব্রিটির তালিকায়ও রয়েছে নারীরা।
‘সেলিব্রিটি’ কথাটির আভিধানিক অর্থ ‘বিখ্যাত বা সুপরিচিত ব্যক্তি’। মূলত খেলাধুলা বা বিনোদন জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিরা এই খেতাব পেয়ে থাকেন। সেলিব্রিটিদের আবার অনেকে ‘তারকা’ বলেও ডাকেন। সেলিব্রিটিদের নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। আর নারী সেলিব্রিটি হলে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিশ্লেষণ যেন বাধ্যতামূলক। এই মানব তারকাদের চেনা-জানার ও তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে আমাদের আগ্রহও সীমাহীন। সেলিব্রিটিদেরও যে নিজেদের ব্যক্তিগত মুহূর্ত থাকতে পারে, তা আমরা ভুলে যাই।
সেলিব্রিটিদের নিয়ে মানুষের এই আগ্রহের অন্যতম কারণ হলো, খ্যাতির প্রতি মানুষের অমোঘ আকর্ষণ। সাধারণ ভক্তরা তাই বিখ্যাত মানুষদের জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনার সঙ্গে নিজের জীবনকে মেলাতে পছন্দ করে। প্রিয় তারকার পছন্দের খাবার, পছন্দের রঙ বা প্রিয় গান, প্রিয় ঋতু বর্ষা, না কি বসন্ত, প্রিয় স্থান পাহাড়, না কি সমুদ্র; এই জিনিসগুলোর প্রতি যতটা আকর্ষণ, তার চেয়েও বেশি আকর্ষণ একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে। আর সেই তারকা যদি হয় একজন নারী, তাহলে তো কথাই নেই। তার জীবন নিয়ে ভক্তদের আগ্রহ থাকে অনেক।
তারকারা ভিনগ্রহের মানুষ নয়, আমাদের মতো রক্তমাংসের মানুষ। তাই তাদের সম্মতি ছাড়া তাদের ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ করা উচিত নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ‘মানুষ মানুষের জন্য’। সুতরাং নারী সেলিব্রেটি হলেও তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমের সহজলভ্যতার বদৌলতে তারকাদের নানা খবরাখবর আমাদের হাতের মুঠোয়। কে কখন কার সঙ্গে প্রেম করছে, কে কাকে বিয়ে করছে, কে কখন সন্তান সম্ভবা হচ্ছে, কোন তারকা হাসপাতালে বাচ্চার জন্ম দিচ্ছে; এসব চটকদার খবর এখন আমাদের মুঠোবন্দি। এসব খবরকে পুঁজি করে চলছে কিছু মুনাফালোভী মানুষের রমরমা ব্যবসা। বিভিন্ন ফেসবুক পেজের বিষয়ই থাকে তারকাদের জীবনের একান্ত বিষয়-আশয়। কিছু সত্যমিথ্যার মিশ্রণে চলে তাদের ব্যবসা। নিজেদের উপার্জনের জন্য তারকাদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে লিখে সস্তা বিনোদন দেয় সাধারণ মানুষকে। আর এজন্য অনেক বিতর্কের মুখোমুখিও হতে হয় তারকাদের, বিশেষ করে নারী তারকাদের।
বিখ্যাত হওয়ার আনন্দের সঙ্গে তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনও পড়ে যায় ঝুঁকিতে। অনেক তারকার বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে বা কেউ পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্বেও জড়িয়ৈ পড়েন। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়তে হয় নারী তারকাদের। তারকা হয়েছে বলেই যে সেই নারীর প্রাইভেসির প্রয়োজন নেই, এমনটা তো নয়। যেখানে ‘নারী’ শব্দটির সঙ্গেই সম্মানের ব্যাপার জড়িত থাকে, সেখানে আমরা কত সহজেই তাদের নিয়ে সমালোচনায় মেতে উঠি। আমাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে ব্যক্তিগত জীবন। আর নারী তারকারাও তার বাইরে নন। অন্যের গোপন মুহূর্ত পাবলিক করার আগে নিজেদের সততা, নৈতিকতা আর আদর্শের জায়গাটুকু একবার তলিয়ে দেখা দরকার। যে আঙুল আমরা নারী তারকাদের দিকে তুলছি, সেই আঙুলগুলো কোনো কারণে যেন আমাদের দিকেই ফিরে আসতে না হয়, সে বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
অভিনয়শিল্পীদের কাজ ছোট পর্দায় বা রুপাল পর্দায় নাটক-সিনেমার মাধ্যমে মানুষকে বিনোদন দেওয়া। পর্দায় তারা আমাদের সামনে যেভাবে থাকে বা আমরা যেভাবে দেখি, বাস্তব জীবনে তারা তা নয়। পর্দার বাইরেও তাদের একটা জীবন রয়েছে। সেখানে হয়তো বা তারা স্বামী-সংসার নিয়ে কাটাতে পছন্দ করে। তার সেই জীবন নিয়ে সমলোচনা করার অধিকার আমাদের কারোই নেই। তারা কাকে বিয়ে করবে, কবে বাচ্চা নেবে, বা কোথায় বাচ্চা জন্ম দেবে, তা তাদের একান্তই নিজের সিদ্ধান্ত। তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ট্রল করা বা অনধিকার চর্চা করা অনৈতিক। অরুচিকর তো বটেই।
যা আমরা চর্চা করি না বা বিশ্বাস করি না, তা ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা প্রত্যেক মানুষের অধিকার। তারকারা ভিনগ্রহের মানুষ নয়, আমাদের মতো রক্তমাংসের মানুষ। তাই তাদের সম্মতি ছাড়া তাদের ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ করা উচিত নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ‘মানুষ মানুষের জন্য’। সুতরাং নারী সেলিব্রেটি হলেও তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।