Skip to content

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মহাভারতের মাদ্রী : আত্মবিসর্জনেই যার সৃষ্টি

মহাভারতের একটি নারী চরিত্র মাদ্রী। হস্তিনাপুরের চন্দ্রবংশীয় রাজা পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী এবং মদ্র দেশের রাজকন্যা তিনি। তার বাবার উত্তরাধিকার হয়েছিল তার ভাই শল্য। রাজা কুন্তিভোজের পালিত কন্যা কুন্তীর সঙ্গে পাণ্ডুর বিয়ে হয়। কিন্তু মদ্ররাজ্যে বহিঃশত্রুর আক্রমণের সময় পাণ্ডু তাদের রাজ্যের হয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনে। ফলে মদ্ররাজ তার কন্যাকে পাণ্ডুর সঙ্গে বিয়ে দিতে ইচ্ছে পোষণ করেন।

পরবর্তীকালে মাদ্রীর সঙ্গে পাণ্ডুর বিয়ে হয়। এরপর পাণ্ডু দুই স্ত্রীর সঙ্গে মৃগয়ার উদ্দেশ্যে বনে যায়। বনে বিচরণকালে মৈথুন-রত এক মৃগদম্পতিকে শরবিদ্ধ করে পাণ্ডু। আহত মৃগ ভূপতিত হয়। ছদ্মবেশ ছেড়ে ঋষি নিজের পরিচয় ব্যক্ত করেন। এই ঋষি ছিলেন কিমিনন্দ মুনি। পুত্র কামনায় মৃগ রূপ ধারণ করে স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমরত ছিলেন। তিনি পাণ্ডুকে অভিশাপ দেন। পাণ্ডু ব্রহ্ম হত্যার পাপ করেছে। পাপের পরিত্রাণ পেলেও স্ত্রী সঙ্গমকালেই তারও মৃত্যু হবে।

পাণ্ডু এই অভিশাপের ফলে পুত্র উৎপাদন অসম্ভব মনে করে দুই স্ত্রীকে নিয়ে তপস্যারত হয়। কিন্তু যজ্ঞ, বেদাধ্যয়ন, তপস্যা করলেও অভিশাপ মুক্ত হয় না। ঘটনা পরম্পরায় পাণ্ডুর দুর্ভাগ্য মাদ্রীর কপালেও দুঃখ ডেকে আনে। মাদ্রীর সঙ্গে কেমন একটা হতভাগ্যের যোগ। নিজের পতির প্রতি ভালোবাসা শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও মুনির অভিশাপে মাদ্রীর জীবনেও নেমে আসে অন্ধকার।

তপস্যারতকালে একদিন হঠাৎ পাণ্ডু কামাবিষ্ট হয়ে ওঠে এবং মাদ্রীর সঙ্গে সঙ্গমে রত হয়। মুনির অভিশাপ মতো পাণ্ডু মৃত্যু বরণ করে। কিন্তু তার আগেই সন্তান আকাঙ্ক্ষায় কুন্তীর দৈব বরলাভের ফলে পুত্র লাভ করে। কুন্তীর পর পর তিন পুত্র জন্মগ্রহণ করে। আর মাদ্রীরও কোলে আসে দুই পুত্র। এই পাঁচ পুত্রই পঞ্চপাণ্ডব। মহাভারতে মাদ্রীর জন্য অনেকটা প্রহসনের জাল বিছানো হয়েছে। যদিও মাদ্রীর সন্তান রূপে জন্ম নেয় নকুল, সহদেব। কিন্তু প্রকৃতার্থে কুন্তীর বরেই তারা জন্ম নেয়। ফলে মাদ্রীর জীবনে কিছু দৈব সত্তা ছাড়া নিজ অংশের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। নকুল, সহদেব তাই কুন্তীর অংশই হয়ে বড় হয়েছে। মায়ের মমতা ও রাজশিক্ষা পেয়ে কুন্তীর আদর্শ মতো বেড়ে উঠেছে।

তবে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের মাদ্রী চরিত্র সৃষ্টির কি খুব দরকার ছিল? কারণ পঞ্চপাণ্ডব কুন্তীরই বর লাভের ফল। তবে মাদ্রীকে কী দিলেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস? মাদ্রী তো জীবন পেয়েও হারিয়েছে। তার রক্তে বহমান কোনো শরীরও জন্ম নেয়নি। তাহলে মাদ্রী চির জনম দুঃখী হিসেবে আত্মবিসর্জনই দিলো!

দুর্বাসা প্রদত্ত বরে পাঁচ পুত্র জন্ম নিলে এবং পাণ্ডবের সঙ্গমকালে মৃত্যু হলে মাদ্রী নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করে। একসময় আত্মহুতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বনবিহারকালে মাদ্রীর রূপ-লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে সঙ্গমরত অবস্থায় পাণ্ডুর মৃত্যু। মাদ্রীর আর্তনাদে কুন্তী সেখানে উপস্থিত হয়। সমস্ত ঘটনা শুনে স্বামীর সঙ্গে সহমরণের অংশ নেয়। মাদ্রী বলে সেই সহমৃতা হতে চায়। আর তার সন্তানদের সে যদি সঠিকভাবে প্রতিপালন না করে তবে লোকনিন্দা হবে। ফলে পুত্রদের পালন ভার কুন্তীর ওপর প্রদান করে মাদ্রী দেহত্যাগ করে। নিকটস্থ ঋষিগণ পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃতদেহ হস্তিনাপুরে নিয়ে যায় এবং সেখানেই তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়।

কয়েকটি বিষয় মাদ্রীর চরিত্র আলোচনা করতে গেলে সামনে আসে। এক্ষেত্রে মাদ্রীর জন্য কী অবশিষ্ট রইলো? মহাভারতে মাদ্রী কি সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত নয়? কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন পাণ্ডবদের সৃষ্টি করলেন সেখানে মাদ্রীকে রাখলেন না। আবার স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হতে হলো। তাহলে এটাই বলা শ্রেয় মাদ্রীকে লেখক শুধু কাহিনি নির্মাণে ব্যবহার করেছেন। তার প্রাপ্তি ও বিসর্জনের ওপর ফোকাস করেননি। পঞ্চপাণ্ডবকে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন যেভাবে জন্ম দেখিয়েছেন, সেখানে মাদ্রী নিতান্তই নিষ্ক্রিয়। কিন্তু তবু তাকে বলি হতে হয়েছে। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, মাদ্রী শুধু পাণ্ডুর মৃত্যুর কারণ হয়েছে। অর্থাৎ পাণ্ডু কিভাবে মৃত্যুবরণ করবে, সেই চিত্রই আঁকতে গিয়ে মাদ্রীকে দাবার গুটি করেছেন।

তবে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন মাদ্রীর চরিত্রে এতটা নিষ্ক্রিয় ভাব না দেখিয়ে বরং মদ্ররাজ্য আক্রমণে জয় না দেখিয়ে নিহত দেখাতে পারতেন। তাহলে আর মাদ্রীর কোনই দরকার ছিল না মহাভারতের কাহিনিতে। সবদিক বিচারে মাদ্রী এক আত্মবিসর্জনের প্রতীক।

অনন্যা/এআই

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ