ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের জগত ও ম্যারি শেলি
'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন'-এর নাম শোনেননি বা টিভিতে অন্তত একবার দেখেননি- এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বিশ্বের বহু লেখককে অনুপ্রাণিত করেছেন। এমনকি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ইউরোপের স্থানীয় লোককথাতেও আশ্রয় করে নিয়েছে। মেরি শেলির বিখ্যাত এই উপন্যাসকে পৃথিবীর সর্বপ্রথম সায়েন্স ফিকশন বলে আখ্যা দেয়া হয়। তবে মেরি শেলিকে মাত্র একটি বইয়ের লেখক ভাবলেই হবে না। তিনি একাধারে লিখেগেছেন অসংখ্য ভ্রমণকাহিনী, উপন্যাস, গল্প, কবিতা। এমনকি স্বামী পার্সি শেলির কবিতাও তিনি সম্পাদনা করতেন। তাই মেরি শেলিকে খুব সহজেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না।
পুরো নাম ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফট শেলি। তখনো তাঁকে ঠিক ম্যারি শেলি বলে ডাকা হতো না। ১৭৯৭ সালের ৩০ আগস্ট জন্মের কদিন পরই মা ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফট মৃত্যুবরণ করেন। হ্যাঁ, ইনিই সেই বিখ্যাত 'ভিনডিকেশন অব দ্য রাইটস অব উইম্যান' বইটি লিখেছেন। ম্যারির মৃত্যুর পর স্বামী উইলিয়াম গডউইন মেয়ের নামও মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে রাখেন। সে-জন্যই ম্যারি শেলির নাম শুরুতে রাখা হয় ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফট গডউইন। উইলিয়াম গডউইন নিজেও উনিশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
গডউইনকে একাই ম্যারির দেখাশোনা করতে হয়। একই সাথে ম্যারির সৎবোন ফ্যানি ইমলেও তাঁর দায়িত্বাধীন। ম্যারির মা-বাবার প্রজ্ঞার কিছুটা হয়তো তিনি পেয়েছিলেন। বিশেষত, অল্প বয়স থেকেই মায়ের লেখাগুলোর সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। তাই মা বেঁচে না থাকলেও মায়ের ভাবনাগুলো তাঁকে আস্তে আস্তে গড়ে তুলছিল।
ম্যারির বয়স যখন ৪, বাবা গডউইন এক প্রতিবেশী মহিলাকে বিয়ে করলেন। এই মহিলার সাথে চার্লস আর জেন নামে আরো দুই ভাই-বোন পরিবারে সংযুক্ত হলেন। এমনকি ১৮০৩ সালে তাঁরা এক পুত্রসন্তানকে জন্ম দিলেন। কিন্তু ম্যারি জেন ক্লেরময়েন্টের সাথে গডউইনের বনিবনা হচ্ছিল না। ম্যারি তাঁর মাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। এ-দিকে বাবার সাথেও ম্যারির সম্পর্ক অনেক ভালো। সেটা আবার ক্লেরমোরের পছন্দ না। ১৮১২ সালেই ক্লেরমোর তাঁর এই সৎ মেয়েটিকে স্কটল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন। বলা চলে ম্যারি তাঁর জীবনের কিছুটা ভালো সময় সেখানেই কাটিয়েছিলেন। নিজের কল্পনাকে সময় দেওয়া এবং সৃষ্টিশীলতার অনুপ্রেরণা সেই গ্রামীণ অঞ্চলেই যেন পেতে শুরু করেন তিনি।
উনিশ শতকেরই অন্য মেয়েদের মতোই ম্যারিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়া হয়নি। ১৮১১ সালে মিস পেটম্যানের মহিলা স্কুলে ছয় মাসের মতো লেখাপড়া করেন তিনি। তবে যাঁর বাবা উইলিয়াম গডউইন, তাঁকে কি আর লেখাপড়া নিয়ে অতটা ভাবতে হয়? বাড়িতেই বাবার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন তিনি। গডউইনের বিশাল লাইব্রেরিতে সময় কাটাতেন। সময়ের বিখ্যাত চিন্তাবিদদের অনেকেই বাবার সাথে দেখা করতে আসতেন। তাঁদের কথাবার্তা সামনাসামনি পর্যবেক্ষণ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। এর মধ্যে রসায়নবিদ স্যার হামফ্রি ডেভি, রবার্ট ওয়েন এবং কবি স্যামুয়েল টেয়লর কোলরিজও ছিলেন।
১৮১২ সালে ম্যারি স্কটল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। এ-সময় কবি পার্সি শেলির সাথে পরিচয়। তাদের মধ্যে এক ধরনের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা আসলে বুদ্ধিবৃত্তিক আদান-প্রদানের ফলেই সম্ভব। গডউইন নিজে সারা জীবন আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছেন। এ-দিকে শেলি এক ব্যারনের সন্তান। শেলিকে তত দিনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তিনি এক বন্ধুর সাথে মিলে 'নাস্তিকতার প্রয়োজন' নামে একটি ছোট পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই ঘটনার পরই শেলি গডউইনকে খুঁজে বের করেন যাতে রাজনৈতিক এবং আদর্শিক জ্ঞানগুলো আহরণ করতে পারেন।
১৮১৪ সালে ম্যারির বয়স সতেরো। এ-দিকে শেলি তার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। এমনকি হ্যারিয়েট রেস্টবুক নামে এক নারীর সাথে সংসার করছেন। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ থাকা অবস্থাতেই পার্সি শেলি এবং ম্যারি একে অপরের প্রেমে পড়ে যান। একসময় ম্যারি মায়ের কবরের সামনে একা একা যেতেন, সেখানেই বসে বসে বই পড়তেন। এখন আর তাঁর প্রয়োজন হয় না। ম্যারি আর শেলি দুজনেই ওলস্টোনক্র্যাফটের কবরে যান, এক সাথে বই পড়েন।
১৮১৪ সালেই ম্যারি, শেলি আর তাঁর বোন ক্লের এক সাথে প্যারিস ঘুরতে যান। সেখানে থাকাকালে ম্যারি একজন লেখক হয়ে উঠতে শুরু করেন। এই ভ্রমণের ঘটনাই তিনি 'হিস্টোরি অব এ সিক্স উইকস ট্যুর' নামে একটি জার্নালে লেখেন। ভ্রমণের টাকা একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার পর তাঁরা আবার ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। গডউইন শেলির ওপর ভীষণ বিরক্ত। লোকেরা নাকি কানাঘুষো করছেন, গডউইন নাকি টাকার বিনিময়ে তাঁর দুই মেয়েকে শেলির কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। মেয়ের এই নতুন সম্পর্ক তিনি মেনে নিতে পারবেন না। শুধু লোকের কানাঘুষোই একমাত্র কারণ না, শেলি নিজেও দায়িত্বজ্ঞানহীন। প্রতিকূল পরিবেশে তাঁর ওপর আস্থা রাখা মুশকিল।
দুজন সম্পর্ক ঠিকই টিকিয়ে রাখলেন। কিন্তু ইংল্যান্ডেই তাঁরা দুজন আর্থিক সমস্যায় বেশি ভোগেন। মূলত, সৎবোন ক্লের-এর সাথে থাকা শুরু করে তাঁরা কিছুটা টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করেন। শেলির ছোটবেলার বন্ধু হগ নিজেও তাঁদের নানাভাবে সাহায্য করার আশ্বাস দেন। ব্যারনের সাথে সংযোগ থাকায় শেলি প্রায়ই পাওনাদারদের থেকে লুকিয়ে থাকতেন। সেই যন্ত্রণার সব চেয়ে বড় ভাগীদার ছিলেন ম্যারি শেলি। সে সময় শেলির সাথে ম্যারির প্রায় দেখাই হতো না। একই সময়ে ম্যারি এক কন্যার জন্ম দেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই কন্যাটি মারা যায়। এই একাকীত্ব এবং শোক ম্যারিকে বিষণ্ণতার দিকে ঠেলে দেয়। এই বিষণ্ণতা তাঁকে পরবর্তী সময়ে 'লোদোরে' উপন্যাস লেখার অনুপ্রেরণা দেয়।
ম্যারি ভয়ংকর হতাশায় ভুগতে শুরু করেন। পরের গ্রীষ্মের ভেতর ম্যারি এই হতাশা থেকে কিছুটা মুক্তি পান। তিনি আর শেলি দুজনেই বিশপগেটের দিকে যাত্রা করেন। তত দিনে পার্সি শেলির দাদা মারা গেছেন। পাওনাদারদের যন্ত্রণা কিছুটা হলেও দূর হয়েছে। ১৮১৬ সালেই ম্যারি আবার এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। বাবার নামের সাথে মিলিয়ে ছেলের নাম রাখেন গডউইন।
এই বসন্তেই ম্যারি যেন নতুনভাবে আবির্ভূত হবেন। তাঁরা মূলত সুইজারল্যান্ডে লর্ড বায়রনের সাথে দেখা করতে গেলেন। বিশপগেটেই জন উইলিয়াম পলিডোরি নামের এক চিকিৎসক তাঁদের সন্তানদের চিকিৎসা করছিলেন। এই ডাক্তারের কাছেই ডারউইনের গবেষণা নিয়ে অনেক গল্প জানা গেল। এই গল্পগুলোই ম্যারিকে প্রভাবিত করল। জুন মাসেই পৃথিবীতে নতুন এক দানবের জন্ম নিল- ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। এই দলটি প্রায়ই ভূতের গল্প বলে একে অপরকে আনন্দদান করতেন। একদিন লর্ড বায়রন জানালেন তারা সবাই নিজের মতো করে একটি ভূতের গল্প লিখে দেখাক। বেশি দিন হলো না, ম্যারি এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখলেন। এবার তিনি ভূতের গল্প লেখা শুরু করলেন।
ইংল্যান্ডে ফিরে আসার পর ম্যারির জীবনে একের পর এক দুর্যোগ নেমে আসতে শুরু করে। ম্যারির সৎবোন ফানি ইমলে সোয়ানসিতে আত্মহত্যা করেন। তারপর আরেক খবর এল। পার্সি শেলির স্ত্রী হ্যারিয়েট হাইড পার্কের পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করেছেন। এই মৃত্যু দুঃখজনক হলেও এবার পার্সি ম্যারিকে বৈধভাবে বিয়ে করতে পারেন। ১৮১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
এমন লেখা আগে কখনো কেও কি লিখেছে!
এই সফলতার পরেও ম্যারির পরিবার আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল। এর মাঝে ম্যারির দুই সন্তানই অদ্ভুতভাবে মৃত্যুবরণ করলেন। ম্যারি আবার হতাশাগ্রস্ত হয়ে ওঠেন। এই ভয়ংকর সময়েই তিনি লিখলেন 'মাথিলডা'। পরবর্তী সময়ে আবার তাঁর মিসক্যারিজ হয়েছিল। একে তো সন্তান হারানোর দুঃখ এবং মিসক্যারিজে নিজের প্রাণ হারানোর ধকল। সব মিলিয়েই ম্যারির সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে একদিন পার্সি পানিতে ডুবে মারা গেলেন। পার্সি আর এডওয়ার্ড মিলে একটি নৌকা কিনেছিলেন। কিন্তু ঘুরতে বের হয়েছিল এক বাজে আবহাওয়ার দিনে। তাঁরা ডুবে গিয়েছিলেন। ম্যারি তো প্রথমে বিশ্বাস করেননি। প্রথমে পার্সির উদ্দেশ্যে একটি চিঠি এসেছিল। পার্সি আদৌ সুস্থভাবে ঘরে ফিরেছে কিনা, তা জানতে চেয়ে চিঠিটি লেখা হয়েছিল। ম্যারি দ্রুত পিসাতে গেলেও জানতে পারলেন, তাঁর স্বামী আসলেই মারা গেছেন। তাদের লাশ তীরে ভেসে এসেছিল।
ম্যারির হৃদয় একেবারেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এ-জন্য নিজের পরিবারকেই ত্যাগ করতে হয়েছে। সেই পার্সিই আর নেই। সেখান থেকেই ম্যারি সারা জীবন প্রায় একাই কাটিয়েছেন। বিধবা হয়ে ইংল্যান্ডে ফেরার পর লর্ড বায়রন থেকে কিছু দিনের জন্যে সাহায্য পেলেন। ম্যারির তখন একটিই সন্তান বেঁচে আছে। শ্বশুরের সাথে দেখা করে সন্তানের খরচ আদায়ের একটা সমঝোতা করা গেল। তবে শ্বশুরের শর্ত- পার্সি শেলিকে নিয়ে কোনো আত্মজীবনী লেখা চলবে না। এ-সময় লেখালেখিই ম্যারির জীবনের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। নিজের লেখাগুলো বাদেও পার্সির পাণ্ডুলিপিগুলো সম্পাদনার চেষ্টা করেন। জীবিতাবস্থায় পার্সি এতটা পরিচিতি পাননি। ম্যারির সম্পাদনায় পার্সি দ্রুতই খ্যাতি লাভ করেন। এরপর একের পর এক বিখ্যাত লেখা তিনি লিখতে শুরু করেন। তিনিই ইংরেজিতে সর্বপ্রথম আপোক্যালিপটিক্যাল উপন্যাস লিখেন। এ-ছাড়া তাঁর লেখাগুলোও নানাভাবে ভিন্ন আঙ্গিক পেতে শুরু করে।
৩৫ বছর বয়সেই নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আর্থিক টানাপোড়ন থেকে তিনি বের হয়ে আসেন। জীবিত থাকা অবস্থায় হয়তো ম্যারির লেখায় কারো তেমন নজর পড়েনি। বরং প্রশ্ন উঠেছে, তিনি আদৌ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন লিখেছিলেন কিনা। কিন্তু প্রায় ২০ বছর প্রচণ্ড অধ্যবসায়ের সাথে তিনি লিখে গেছেন। কলম থামাননি। নিজে ভালোবাসার মানুষের নামটিকেও পরিচিত করিয়েছেন সারা বিশ্বে। পার্সি শেলিকে সমগ্র বিশ্বে পরিচিত করে তোলা এবং ইংরেজি সাহিত্যে এক অসাধারণ কবির অন্তর্ভুক্তি অন্তত ম্যারি শেলিকে ছাড়া সম্ভব ছিল না। প্রচণ্ড মানসিক শক্তিমত্তার অধিকারী ম্যারি শেলির জীবন যেন এক অভিযান। সেই অভিযানের গল্প শুধু ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের তর্কেই চাপা পড়ে আছে!