Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চিকিৎসকের ভূমিকায় প্রথম নারী এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল

বর্তমান সময়ে মার্কিন নারীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। কিন্তু ঠিক দুশো বছর আগেও সবকিছু এরকম ছিলোনা। বিশেষত চিকিৎসাক্ষেত্রে নারীরা বড়জোর সেবিকার ভূমিকা পালন করতে পারতো। কিন্তু একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক? সম্ভবত না। কিন্তু ঠিক প্রতিকূল সময়েই যেন কেউ না কেউ প্রথা ভাঙবেই। ইতিহাসে নারীরা সবসময় প্রতিকূলতার বাধ ডিঙিয়েই স্থাপন করেছেন অনন্য নজির। এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলও আমেরিকায় মহিলাদের মধ্যে প্রথম মেডিকেল ডিগ্রি পেয়ে নারীদের এই পেশায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন।

 

এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল ১৮২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ব্রিস্টলে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা স্যামুয়েল ব্ল্যাকওয়েল একজন চিনি পরিশোধনকারী, এবং দাসপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ব্যক্তি। মা হানা লেন নয় সন্তান প্রতিপালনে ব্যস্ত। নয় সন্তানের মধ্যে এলিজাবেথ তৃতীয়। ১৮৩২ সালে এলিজাবেথ সপরিবারে আমেরিকার ওহাইওতে চলে আসেন। ঠিক ছয় বছর পর পরিবারের কর্তা স্যামুয়েল ব্ল্যাকওয়েল মৃত্যুবরণ করেন। ব্ল্যাকওয়েল পরিবার যেন আচমকা আর্থিক মন্দার মুখোমুখি হয়। এই ভয়ংকর সমস্যার মাঝেও ব্ল্যাকওয়েল ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখলেন কিভাবে?

 

ব্ল্যাকওয়েলের এক বান্ধবীর বেশ বড়সড় রোগ হয়। পরবর্তীতে সে মারা যায়। একদিন সেই বান্ধবী ব্ল্যাকওয়েলকে জানায়, যদি তার চিকিৎসার ভার কোনো মহিলা ফিজিশিয়ানের হাতে হতো, তাহলে সে দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠতো। এলিজাবেথ সেখান থেকেই মেডিসিনে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন। কিন্তু এখানেই সমস্যা। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা নেহাৎ বেশি না। অনেক ফিজিশিয়ান অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শিক্ষানবিশ হওয়ার মাধ্যমেই শিক্ষা সম্পন্ন করতো। কোনো কলেজেই নারীদের ভর্তি হওয়ার সুযোগ নেই। তবে সে সময় কিছু মহিলা শিক্ষানবিশ হয়ে লাইসেন্সবিহীন ডাক্তারের ভূমিকা পালন করছিলো। এসময় এলিজাবেথ, তার মা ও দুই বড় বোন শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত হয়।

 

শিক্ষকতার সাথে নিযুক্ত থাকাকালীন এলিজাবেথের সাথে দুটি পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে যাদের দুজনই সাউদার্ন ফিজিশিয়ান। এই দুই চিকিৎসক থেকেই এলিজাবেথ চিকিৎসাবিদ্যা শিখতে শুরু করেন। ১৮৪৭ সালে ফিলাডেলফিয়ায় ফিরেই এলিজাবেথ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ খুঁজতে শুরু করেন। কিন্তু প্রায় প্রতিটি কলেজই তার আবেদন বাতিল করে দেয়। তাও হাল ছাড়লেন না এলিজাবেথ। অবশেষে নিউ ইয়র্কের জেনেভা কলেজে তিনি ভর্তি হতে সমর্থ হন। যদিও তাকে দেয়া অনুমতিটি ছিলো নিছক রসিকতা। ফ্যাকাল্টি ভেবেছিলেন যে ছেলেদের জন্যে গড়া এই কলেজে কেউওই এক নারীকে ভর্তির বিষয়ে রাজি হবেন না। তাই তিনি এক ভোটের আয়োজন করেন যেখানে সকল ছেলেই রসিকতা করে পক্ষে ভোট দেন। ব্যাস, এলিজাবেথ সুযোগ পেয়ে গেলেন।

 

কলেজে থাকাকালীন এলিজাবেথকে বহু যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। প্রফেসররা সবসময় লেকচারের সময় তাকে আলাদা কোণে বসতে বাধ্য করে। এমনকি অনেক সময় ল্যাবে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হতোনা। স্থানীয় মানুষদের কাছে এমন কিম্ভুত নারী চিকিৎসকের গল্প রটে গেছে বহু আগেই। রাস্তায় দেখা হলেই তারা এলিজাবেথকে বজ্জাত মেয়ে বলে গাল দিতো। নিজের ঘর সামলানোর দায়িত্ব ছেড়ে চিকিৎসক হওয়ার বদমতলব ছেড়ে দেওয়ার সুপরামর্শও কম আসেনি। যাহোক, খুব দ্রুতই এলিজাবেথ তার সহপাঠী এবং প্রফেসরদের মনোযোগ আকর্ষণ করে বসেন। অবশেষে ১৮৪৯ সালে নিজের শ্রেণীতে প্রথম হয়ে তিনি গ্র্যাজুয়েশন করেন। 

 

এলিজাবেথ আমেরিকান মেডিক্যাল স্কুল থেকে এমডি ডিগ্রি পাওয়া প্রথম নারী। কিন্তু এই অর্জন তো মাত্র তার জীবনের শুরু। লন্ডন ও প্যারিসে এরপর তিনি দুবছর চিকিৎসকের কাজ করেন। লা ম্যাতারনিটে মিডওয়াইফারি নিয়ে পড়াশোনা করার সময়ে প্যারুলেন্ট অপথালমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিন এক চোখের দৃষ্টিশক্তি খুইয়ে বসেন।

 

তবে এই ঘটনায় এলিজাবেথ মোটেও নিরুৎসাহিত হন নি। ১৮৫১ সালে আমেরিকায় ফিরে এলিজাবেথ নিউ ইয়র্কে প্র্যাকটিস শুরু করেন। ১৮৫৩ সালেই এলিজাবেথ নিজের ডিসপেন্সারি চালু করেন। এলিজাবেথের বোন এমিলিও ততদিনে ডাক্তারি ডিগ্রি নিয়ে ডিসপেন্সারিতে যোগ দেন। ১৮৫৭ সালে তার সহকর্মী ডাক্তার ম্যারি যাকেরযেউস্কা এবং তার বোন এ্যামিলি ব্ল্যাকওয়েলের সহযোগিতায় একটি হাসপাতাল নির্মাণ করেন যেখানে, অভাবী নারী ও শিশুদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হতো। একই বছর প্রথম নারী চিকিৎসক হিসেবে ব্রিটিশ মেডিক্যাল রেজিস্ট্রারে তার নাম ওঠানো হয়। 

 

১৮৬০ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত এলিজাবেথ ব্রিটেনে ব্ল্যাকওয়েল চিকিৎসাশাস্ত্রে নারীদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কাজ করে যান। এমনকি আমেরিকাতে প্রথম নারীদের জন্যে ১৮৬৮ সালের নভেম্বরে মেডিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৬৯ সালে তিনি ব্রিটেনে ফিরে আবার নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৮৭১ সালে নিজ উদ্যোগে এলিজাবেথ ন্যাশনাল হেলথ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সোসাইটির ঘোষিত "প্রতিরোধ প্রতিকারের চেয়ে শ্রেয়" এখনো সমগ্র বিশ্বে পরিচিত। তার মেডিক্যাল স্কুলে নারীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞান দেয়া হতো। নিজ উদ্যোগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে একটি ‘যুক্তরাষ্ট্র স্যানিটারি কমিশন’ গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিল। পরবর্তীতে তারই একজন ছাত্রের তৈরি লন্ডনের একটি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি।

 

১৯৭৭ সালে চিকিৎসকের দায়িত্ব থেকে তিনি অবসর নেন। তবে নিজের ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করার কাজে থেমে থাকেননি। ১৮৯৫ সালে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর একটি বই লিখেন। যদিও সেখানে মেটাফিজিক্স নিয়েই তিনি আলোচনা করেছেন বেশি। যদিও এলিজাবেথের মৃত্যুর অনেক পরে অধ্যাপকরা আরো কিছু লেখা খুঁজে পান। নিজের বইয়ে তিনি লেখেন, "ইতিহাস এবং মেটাফিজিক্স আমার প্রিয় বিষয়। মানুষের শরীর মূলত অনেকগুলো গড়নের সন্নিবেশ। কোন মেডিক্যাল সায়েন্স এই গড়নগুলোকে পরিপূর্ণরূপে বুঝতে পারবে কিনা সেবিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’'

 

অবসরের পর নিজের জীবনের দুই দশক কোনো প্র্যাকটিস হয়তো করেননি। কিন্তু মেডিক্যাল বিজ্ঞানে তার মনোযোগের কমতি ছিলোনা। ১৯১০ সালের ৩১ মে, এই মহাত্মা ইংল্যান্ডের হ্যাস্টিংসে মৃত্যুবরণ করেন।

 

এলিজাবেথকে তার সারাজীবন লড়াই করতে হয়েছে। ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের এলিজাবেথ ধৈর্য এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে গেছেন। তার অধ্যবসায় সেসময় নানা কটু মন্তব্য কিংবা রসিকতার অবসর টেনে এনেছে। কিন্তু একসময় তার প্রতিভাকে স্বীকার করতে বাধ্য হয় সকলে। চিকিৎসাশাস্ত্রে অবদানের জন্যে তিনি বেশকিছু পুরষ্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু তার সংগ্রামের ফলাফল অন্যভাবে বিবেচনা করতে হবে। এলিজাবেথ যখন চিকিৎসাশাস্ত্রে নারীদের প্রবেশ নিয়ে লড়াই করছেন, তখন লাইসেন্সপ্রাপ্ত নারী ডাক্তারের সংখ্যা ছিলো শূন্য। ১৮৮১ সালে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে মোট ২৫ জন নারী ডাক্তার পাওয়া যায়। সেই সংখ্যা ১৯১১ সালের মাঝেই ৪৯৫ জনে উত্তীর্ণ হয়। এলিজাবেথের এই সাহসী পদক্ষেপ নারীদের যেন নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠায় বহু বছর এগিয়ে নিয়ে গেছে। 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ