খান জাহান আলীর মাজারের গিলাফ পরিবর্তন করেন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা
খুলনার আঞ্চলিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে ‘কে কে খুলনা’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল বেশ-কিছুদিন ধরে কাজ করে চলেছে। নিজেদের ফেসবুক গ্ৰুপ পেজেও তারা নিয়মিত সক্রিয় থাকে। তাদের সুন্দর সাবলীল উপস্থাপনায় প্রতিটি এপিসোড বেশ মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, দলটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, ‘নোনাপানি’খ্যাত খুলনার তরুণ তুর্কী পরিচালক সৈয়দা নিগার বানু। আজকের দিনে যেদিকে তাকাবেন, দেখবেন, ইউটিউবেরও হাজার হাজার চ্যানেল। সেখানে কোনোরকমে দায়সারা গোছের একটা ভিডিও করে ছেড়ে দিচ্ছেন ইউটিউবাররা। অথচ তাদের বিপরীতে ‘কে কে খুলনা’র সুশিক্ষিত কয়েকজন তরুণ-তরুণী কাজ করছেন গবেষণানির্ভর। তাদের কাছে থাকছে নির্ভুল তথ্য।
অনেকেই মনে করেন, মাজারগুলো ধর্মীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনের ধারক-বাহক। খুলনার বাগেরহাটে খান জাহান আলীর মাজারে উরস নিয়ে একটি সুন্দর তথ্যচিত্র তৈরি করেছে ‘কে কে খুলনা’ গোষ্ঠী । উরস অর্থ হলো মিলনউৎসব। খান জাহান আলীর মাজারে প্রতিবছর চৈত্র মাসে পূর্ণিমায় এই উরম অনুষ্ঠিত হয়। জানা গেছে, ওই দিনে খান জাহান আলীর মৃত্যুবরণ করেছেন।
ঐতিহাসিকদের নানা তথ্য থেকে জানা গেছে, খান জাহান আলী ছিলেন রাজর্ষি। একদিকে প্রজাহিতৈষী রাজা,অন্যদিকে সন্ন্যাসী। ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য একদা তিনি জৌনপুর রাজ্য থেকে পশ্চিমাঞ্চলে খুলনার বাগেরহাটে চলে আসেন। ইসলাম ধর্মের প্রচারক হলেও অন্যান্য ধর্মের মানুষের প্রতিও তাঁর অপার শ্রদ্ধা ছিল। মাজারে একটি বড় দিঘি রয়েছে। এই দিঘিটাকে অনেকে ঠাকুরঘাটও বলে। কারণ বাগেরহাটের হিন্দুরাও তাঁকে ‘ঠাকুর’ বলে মানতো। ব্রাহ্মণ থেকে নমঃশূদ্র, সব শ্রেণীর মানুষের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
এখনো প্রত্যেক ধর্মের মানুষ এই মাজারে আসে। নারী-পুরুষ পাশাপাশি বসে প্রার্থনা করে। গানবাজনার মাধ্যমেও শ্রদ্ধা নিবেদন, পারস্পরিক আনন্দ ভাগ করে নেয়। আবার মানুষের সংস্কার, কিছু অন্ধবিশ্বাসও রয়েছে এই মাজারকে ঘিরে। দিঘির স্বচ্ছ জল অনেকে তুলে নিয়ে যায়, পান করলে রোগ ব্যাধি মুক্ত হবে, এই আশায়। কেউ মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য দিঘিতে শিং মাছের পোনা ছাড়ে। আবার কেউ দিঘির কুমীরকে মাংস খেতে দেয়।
লোকশ্রুতি বলছে, খান জাহান আলী নাকি কুমিরের পিঠে চড়ে জৌনপুর থেকে বাগেরহাট এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে অনেক কুমির এনে এখানে ছেড়ে দেন।
আবার মাজারকে কেন্দ্র করে বিচিত্র কাজকর্ম এখানে হয়। কেউ তুকতাক, মাদুলি তাবিজ-কবচ দেয়। কেউ খেলনা বা ঘর সাজানোর জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসে।
তবে ‘কে কে খুলনা’ গোষ্ঠী তথ্যচিত্রে বিশেষ যে বিষয়টি তুলে এনেছে, তা হলো, বাৎসরিক উরসে মাজারের গিলাফ পরিবর্তন। আমরা সাধারণত, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের বিশেষ কোনো ধর্ম, ধর্মীয় আচরণ বা উৎসব অনুষ্ঠান থাকতে পারে তা আমরা কখনো ভেবে উঠতে পারি না। এই মাজারে সমাধির ওপরে একটি বড় কারুকার্যখচিত সুসজ্জিত চাদর বা গিলাফটি রয়েছে। এটি প্রতিবছর পরিবর্তন করে দেয় তৃতীয় লিঙ্গে জনগোষ্ঠী, তাদের সারাবছরের কষ্টার্জিত টাকায়।
গোটা বাংলাদেশ ও ভারত থেকেও তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা উরসে এখানে এসে হাজির হয়। সারাদিন ধর্মীয় সংগীতে প্রাণ খুলে নাচে, গান করে। রাতে ব্যান্ড পার্টির বাদ্যসহ, ‘লা ইলাহা ইল্লালা ‘ বলতে বলতে বড় লম্বা গিলাফটি নিয়ে মাজারে ঢোকে। নতুন গিলাফ পেতে দিয়ে নিচের পুরোনো গিলাফ সরিয়ে আনা হয়। দীর্ঘ বঞ্চনার জীবন সমবেত প্রার্থনায় এক অন্য মাত্রা পায়। একটি মাজারে উৎসবে এভাবেও যে সামাজিক লিঙ্গ বৈষম্য, ভেদাভেদ দূরে হটে যায়, যাঁরা প্রান্তিক যাঁরা কোণঠাসা, সমাজ যাদের ভালো চোখে দেখে না, তাঁরাও যে বড় দায়িত্ব পালন করতে পারেন এই নজির গড়ে তুলতে পারা কম বড় কথা নয়।
সৈয়দা নিগার বানুর স্ক্রিপ্ট, ক্যামেরা ও সম্পাদনা এই তথ্যচিত্রটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে।