ইভানা’র আত্মহত্যা সমাজে নারীদের অবস্থা নির্দেশ করে
সম্প্রতি ইভানা নামক এক নারীর আত্মহত্যা গণমাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলেছে। কী এমন হয়েছিলো যা দুই সন্তানকে রেখে তাকে আত্মহত্যার জন্য বাধ্য করলো? এই প্রশ্নটি বারবার সামনে আসছে। ইভানার সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থাই মূলত তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে।
পুরো নাম ইভানা লায়লা চৌধুরী। ৩২ বছর বয়সী এই নারী স্কলাসটিকার মত প্রথম সারির একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ইউনিভার্সিটি প্লেসমেন্ট সার্ভিসেসের উপব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করতেন। স্বামীর পরকিয়ার কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেন। বেশ কয়েকদিন থেকেই স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি থেকে বিভিন্ন মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন তিনি। অথচ এই বিয়ের জন্য তাকে একদিন ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিলো। পরিবারের চাপে ব্যারিস্টারি পড়তে বাইরে যাওয়া হয়নি তার।
বেশ বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে ইভানা। ইভানার বাবা প্রকৌশলী আমান উল্লাহ চৌধুরী সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী। বিআরটিএর পরিচালক থাকা অবস্থায় তিনি অবসরে যান। তার তিন মেয়ের মধ্যে ইভানা সবার ছোট। নাম করা ইংরেজি স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ব্যারিস্টারিতে ভর্তি হন তিনি। ফাইনাল ইয়ারে যখন তার বাইরে যাওয়ার কথা, এতদিনের স্বপ্নকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার কথা, তখন পরিবার তার পায়ে বেঁধে দেয় বিবাহের শিকল। নিজে ব্যারিস্টার হওয়ার থেকে একজন ব্যারিস্টারের বউ হওয়াকেই বাধ্য হয়ে গ্রহণ করতে হয় এই মেধাবী শিক্ষার্থীকে।
ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ হাসান মাহমুদ ওরফে রুম্মানের সাথে ২০১০ সালে বিয়ে হয় ইভানার। জানা যায়, বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই স্বামীর থেকে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার হতে থাকেন ইভানা। তাদের দুই সন্তান রয়েছে। দুই ছেলের মধ্যে একটির বয়স আট বছর, আরেকটি ছয় বছরের। ছোটটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (অটিস্টিক) শিশু।
ইভানার স্বামী বিবাহ বহির্ভূত অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। বছরখানেক আগে ইভানা সে ব্যাপারে জানতে পারেন। তার স্বামীর পরিবারও বিষয়টি জানতো এবং তারা ইভানার চলে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলো। ইভানার ধারণা ছিল তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি তাকে বের করে দেওয়ার কথা ভাবছিলো। আসলেই তা ঠিক। ইভানার স্বামী তাকে তালাকের কথা জানায়। ইভানা তার এক বন্ধুকে লিখেছিলো, “সম্ভাব্য তালাকের চিন্তায় আমার ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার মা–বাবা সহ্য করতে পারবেন না। তাদের দুজনেরই বয়স হয়েছে। নানা রকম শারীরিক জটিলতা আছে”। স্বামীর সাথে সম্ভাব্য বিচ্ছেদ ইভানা মেনে নিতে পারছিলেন না।
বিষণ্ণতা মানুষকে প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা এবং আশাহীনতার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায়, যার ফলে তারা কষ্ট দূর করার অন্য উপায় দেখতে অক্ষম হয়। নিজেদের জীবনকে শেষ করাকে যন্ত্রণা মুক্তির সহজ উপায় হিসেবে বেছে নেয়। ইভানার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। গবেষণায় দেখা গেছে হতাশা, তা স্বল্পমেয়াদী বা দীর্ঘস্থায়ী যাই হোক না কেন, আত্মহত্যার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। হতাশাগ্রস্ত একজন মানুষ মনে করে যে সে তার সব আশা, স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছে এবং উপায়-হীনতায় ভুগতে ভুগতে আত্মহত্যাকে একটি কার্যকর বিকল্প বলে মনে করে।
অবশেষে এতো যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে গত ১৫ সেপ্টেম্বর শাহবাগের পাশে পরীবাগের নয়তলা ভবনের ছাদ দিয়ে আত্মহত্যা করে ইভানা। মৃত্যুর আগে ইভানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি কমেন্টে বলেছিলো, “জীবনটা একটি কঠিন জার্নি, বিয়ের ১০ বছর পর আমার উপলব্ধি হলো, সত্যিই নিঃশ্বাস নিতে পারা কষ্টকর। আমি সিঙ্গেল জীবন কাটাব তার জন্য প্রস্তুত নই। আমার দুই সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় আমি নেই। কেননা আমাদের সমাজ সব সময় ছেলেদের পক্ষে। আমি আজ এখানে লিখছি, এক মাস হাসিমুখে থাকার পরও আমি মৃত্যুকে মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমার ছোট সন্তান আমাকে মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরিয়ে আনছে। এই অবুঝ শিশুদের মধ্যে অদ্ভুত শক্তি রয়েছে।”
ইভানার এই আত্মহত্যার দায় কার? তার নিজের? তার স্বামী? তার পরিবারের? নাকি সমাজের? প্রকৃতপক্ষে উল্লিখিত সবগুলোই তাকে ক্রমে ক্রমে এই পদক্ষেপের দিতে এগিয়ে দিয়েছে। ভালো ছেলে দেখে মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়ার লোভ সামলাতে পারেনি ইভানার পরিবার। নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেয়ার পরিবর্তে মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বিয়ে দিয়ে দেয় তাকে। আবার মেয়ের অসময়ে কোনো সাপোর্টও করেনি তার পরিবার। আর সমাজ তো আছেই যা- ই হোক না কেন সব দোষ মেয়ের ওপর দেয়ার জন্য!
আমাদের সমাজে এরকম অনেক ইভানা আছে যারা নিজের স্বপ্নের জলাঞ্জলি দিয়ে বসেন বিয়ের পিড়িতে। পরিবার, সমাজ থেকে তাকে এটিই শেখানো হয় যে বিয়ে, স্বামী এসবই জীবনের মূল লক্ষ্য। এর দায় সমাজ কোনোভাবেই এড়াতে পারেনা।