Skip to content

২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | মঙ্গলবার | ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারী-নির্যাতন রোধে খুতবা-ওয়াজ

নারী-নির্যাতনের ঘটনা নতুন কিছু না। শতশত বছর আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। তবে আজ সভ্যতা ও ভব্যতা যতদূরে এসেছে তাতে নারী-নির্যাতনের ঘটনা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। পৃথিবী পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে মানবিকবোধে উন্নত হয়েছে—মানুষ আর সেই বর্বর-আদিম জীবটি নেই। মানুষ হিসেবে নারী তার অবস্থান তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন; যোগ্যতাবলে ও কর্মগুণে প্রমাণ করেছেন নারী-পুরুষের মধ্যে যে বিভেদটুকু বর্তমান তা কেবলই বায়োলজিক্যাল; আর যেসব বিভেদ খাঁড়া করা হচ্ছে সবই বানোয়াট—যুগে যুগে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নারীকে খাটো করবার প্রয়াসে সে-সব ‘মতাদর্শ’ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

 

নারী পুরুষের অধীনস্থ, নারী ঊনমানুষ—এসব বলতে বলতে একটা সময় ‘গোবেলিয়ান লাই’র মতো নারী নিজেও তা সত্য বলে মেনে নিয়েছে। বিশ্বের জনসংখ্যায় আধাআধি হলেও নারীকে সংখ্যালঘুর মতো করে ভাবতে শেখানো হয়েছে। এ-সবই হলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার একটা ‘বিগ প্লট’র অংশবিশেষ। সভ্যতার পরিপূর্ণ বিকাশকালেও যে নারী-নির্যাতন বন্ধ হয়নি, বরং তার সঙ্গে নতুন নতুন নাম, নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, তার কারণ হিসেবে বলা যায়, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমরা সকলে এর সঙ্গে জড়িত। এ দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

 

বাংলাদেশের নারী-নির্যাতনে যে ‘নবমাত্রা’ যোগ হয়েছে তাতে আমাদের মসজিদের ইমাম ও ইসলামিক স্কলারদের অনেক কিছু করবার আছে। অন্যান্য যেকোনো সংগঠনের চেয়ে তাঁদের বক্তব্য অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে। বাংলাদেশ মুসলিম-অধ্যুষিত রাষ্ট্র, কমবেশি সকলে নামাজ পড়েন; বিশেষ করে শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায় করার চেষ্টা করেন প্রতিটা ধর্মপ্রাণ মুসলিম। সেখানে ইসলাম যে নারীর মর্যাদা দিয়েছে, সে-সম্পর্কে আলাদা করে খুতবা দেয়া যেতে পারে। মৌলানারা প্রায়ই বিভিন্ন ইসলামিক জলসায় ওয়াজ করেন। সেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ এক কাতারে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাঁদের ওয়াজ শোনেন। আমলে আনার ব্যাপারে মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। অনেক সময় মৌলানা নিজেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করান। কাজেই মৌলানা সাহেবরা যদি নারীর মর্যাদা নিয়ে কথা বলেন, নারীকে অসম্মান ও যৌননির্যাতনে ইসলামে দুনিয়াতে ও পরকালে যে সাজার বিধান রয়েছে তা তুলে ধরেন, তাহলে বিষয়টি বেশ কাজে দেবে।

 

খুতবা কিংবা ওয়াজ মাহফিলে নারীর মর্যাদা নিয়ে একেবারে যে বলা হয় না, তা কিন্তু না। একজন মুসলমান হিসেবে আমি বহু ওয়াজ মাহফিলে শ্রোতাবেশে অংশ নিয়েছি। জুম্মার নামাজে খুতবা শুনে আসছি। আমি লক্ষ করেছি, নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গ এলে নির্যাতনকারীর চেয়ে নির্যাতনের শিকার নারীর সমালোচনা করা হয় বেশি। নারীর চলাফেরা, পোশাক-আশাক নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। অথচ জোর দিয়ে বলা হয় না, কোনো পরিস্থিতিতেই নারীর ওপর পাশবিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ইসলামের কোথাও বলা হয়নি। পুরুষকেও তার দৃষ্টি অবনত করে চলার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, আখলাকের গুরুত্ব নারী-পুরুষ সবার জন্যে সমান। কোনো পরিস্থিতিতেই পুরুষকে ধর্ষক হওয়ার সুযোগ ইসলাম দেয়নি। বরং চরিত্র বাঁচানো ফরজ ইবাদত বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

 

অথচ আমরা বিভিন্ন খুতবাতে নারীকে তেঁতুল কিংবা রসগোল্লার সঙ্গে তুলনা করতে দেখি। মসজিদের মিনারে দাঁড়িয়ে নারীর বিরুদ্ধে এই অশ্লীল উপমা খাড়া করা হয়। ‘তেঁতুল দেখলে জ্বিবে জল আসবেই, নারী হলো তেঁতুল!’ — এ কথা বলে পরোক্ষভাবে পথেঘাটে নারী-নির্যাতনকে জাস্টিফাই করা হয়। একজন ইমাম হয়ত তাঁর অজান্তেই একজন ধর্ষক কিংবা নারী-নির্যাতনকারীর পক্ষ নিয়ে বসেন। এটাকে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা বা অবমাননা হিসেবে দেখা যেতে পারে। আবার অনেক ইমাম আছেন যারা নিজেরা নারী-বিদ্বেষী মনোভাব লালন করেন। মসজিদ কমিটির উচিত হবে সে-সব ইমামকে নজরদারির ভেতর রাখা। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পাশ করে বেশিরভাগ ছাত্র পেশা হিসেবে ইমামতীকে বেছে নেন। তাই মাদরাসা শিক্ষার ভেতর নারী-বিদ্বেষী শিক্ষা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে নারীকে দমিয়ে রাখার জন্যে আল কুরআনের কোনো আয়াত বা হাদিস কোড করা থেকে বিরত থাকতে হবে।  

 

আমাদের চাওয়া, আমাদের যারা নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দিচ্ছেন, জেন্ডার ইস্যুতে তারা আরো সেনসিটিভ ও সেনসিবল হবেন। আমরা চাইবো, ফিলিস্তিন কিংবা কোনো ইসলামিক রাষ্ট্রে ইহুদি বা খ্রিস্টান রাষ্ট্র হামলা করলে যেমন সঙ্গে সঙ্গে নিন্দা জানানো হয়, ভুক্তভোগীদের জন্যে প্রার্থনা করা হয়; দেশে নারী-নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও যেন তেমন করে তাৎক্ষণিক নিন্দা জানানো হয় এবং নির্যাতনের শিকার নারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্যে প্রার্থনা করা হয়। এভাবেই সকলকে জানিয়ে দেয়া সম্ভব—ইসলামে নারী নির্যাতনকারীর কোনো ঠাঁই নেই; এবং ইসলামধর্মে নারী-পুরুষ সমমর্যাদায় আসীন। যৌনসন্ত্রাসদের বিরুদ্ধে চতুর্দিক থেকে আন্দোলন ধেয়ে আসুক, নারী মুক্তির মধ্যে দিয়ে জয় হোক মানবতার।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ