মিয়াঁও বাড়ির মালিক দীপান্বিতার গল্প
ভিন্নচোখে
মিয়াঁও বাড়ির মালিক দীপান্বিতার গল্প
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী স্কুলে যাওয়ার পথে দেখল তারই সমবয়েসি কয়েকজন একটি বিড়ালকে পানিতে ডোবাচ্ছে। এটাই তাদের খেলা। এ কেমন খেলা? যা-ই হোক, মেয়েটি তাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে বিড়ালটি ঘরে নিয়ে আসে। শুরু হলো একটি অধ্যায়। আরেকদিন মেয়েটি খুবই অবাক হলো, একদল মানুষ লাঠিসোটা দিয়ে একটি কুকুরকে মারছে। পালাতে গিয়ে পথ খুঁজে না পাওয়া কুকুরটিও আশ্রয় পেল। সেই থেকেই দীপান্বিতা হৃদির গল্প শুরু।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মাহমুদপুর এলাকার একটি বাড়িকে স্থানীয়রা সবাই চেনে ‘বিড়াল বাড়ি’ হিসেবে। কারণ এই বাড়িতে আশ্রয় মিলেছে অসংখ্য বিড়ালের, যাদের প্রায় সবাই কোনো-না-কোনোভাবে শারীরিক আঘাতপ্রাপ্ত। বাড়িটির মালিক দীপান্বিতা রিদি। তার তত্ত্বাবধানেই চলে এসব বিড়ালের লালন-পালন। দোতলা বাড়িটির বসার ঘর, খাবার টেবিল, শোবারঘর, বারান্দা কোথায় নেই বিড়াল? কেউ খাচ্ছে, কেউবা ঘুমাচ্ছে, কেউ আবার দোলনায় দোল খাচ্ছে। কোনোটি হয়ত জানালার গ্রিলে বসে রোদ পোহাচ্ছে, আরেকটি ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙছে টেবিলের কার্নিশে। চারদিকে মিয়াঁও মিয়াঁও রবে কানপাতা দায়।
এখানকার আশ্রিত বিড়ালগুলোর কোনোটার পা কাটা, কোনোটার চোখ নেই, কারও মালিক তাকে রেখে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে, মানুষের নির্মমতার শিকার হয়েও এসেছে কোনোটা। এমন সব অসহায় বিড়ালের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে এই বাড়ি। আশ্রয়কেন্দ্রের নাম ‘এএলবি অ্যানিমেল শেল্টার’। তবে মানুষ এটিকে একনামে চেনে ‘বিড়াল বাড়ি’ হিসেবে। রিও, অরেঞ্জ, ডেক্সটার, বিল্টি, টুকি, টোটন, লিও, ছোট, মমো, ফ্রুটি, পমপমসহ বাড়িতে মোট বিড়ালের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। তবে এদের মধ্যে স্থায়ী বাসিন্দা ৪০টি।
দেড় বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা দ্বিতল বাড়ির পুরোটিই বিড়ালদের জন্য দিয়ে দিয়েছেন বাড়ির মালিক দীপান্বিতা রিদি। শুধু বিড়ালই নয়, এখানে রয়েছে গোটা দশেক কুকুরও। কুকুর-বিড়ালগুলো এখানে থাকছে পরম মমতায়। পশুপ্রেমী এই তরুণী বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোথাও কেউ আহত বিড়াল-কুকুর দেখলে আমাদের খবর দেয়। তখন তাদের এই শেল্টারে নিয়ে আসি।
দীপান্বিতা বলেন, মানুষের নির্মমতার শিকার, হারিয়ে যাওয়া বা কোনোভাবে আহত হয়েছেÑএমন বিড়াল-কুকুরের সন্ধান পেলেই তাদের রক্ষা করে এই আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসি। এ কাজে সহায়তার জন্য আমাদের শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী রয়েছে।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী দীপান্বিতা ভবিষ্যতে তার কাজের পরিধি আরও বাড়াতে চান। তবে অর্থের অভাবে এখন এই কাজ এগিয়ে নেওয়া কঠিন হচ্ছে জানিয়ে পশুপ্রেমীদের সহায়তা প্রত্যাশা করেন তিনি। দীপান্বিতা জানান, অসুস্থ বিড়ালকে সুস্থ করে বা বিড়ালছানাকে একটু বড়ো করে আগ্রহী পশুপ্রেমীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তবে তা করা হয় একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আশ্রয়কেন্দ্রের নামে ওয়েবসাইটে িিি (.ধষনংযবষঃবৎ.পড়স) গিয়ে আগ্রহীরা বিনাপয়সায় পছন্দের বিড়াল নিতে পারবেন। তবে কেউ যদি ব্যক্তিগত বিড়াল কিছুদিনের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে রাখতে চান, তাহলে তাকে দিতে হয় অল্প কিছু ফি। এ টাকাও তিনি খরচ করেন কুকুর-বিড়ালদের খাবার কেনায়।
বিড়ালদের দুবেলা ভাত-মাছ আর একবেলা ক্যাট বিস্কুট খাওয়ানো হয়। আর কুকুরদের দেওয়া হয় মুরগি। দৈনিক চার কেজি চালের ভাত, চার কেজি মাছ, দুই কেজি বিস্কুট ও দুই কেজি মুরগি লাগে তাদের জন্য।
দীপান্বিতা বলেন, প্রাণীগুলোকে তিনবেলা খাবার দেওয়াসহ টিকা, চিকিৎসা ও অন্যান্য খরচ বাবদ মাসে ৪০-৪৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এর অধিকাংশই আমার বাবা দিচ্ছেন। তবে তার পক্ষে খুব বেশিদিন এভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
‘অ্যানিমেল লাভার বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন করেছেন দীপান্বিতা। ‘এএলবি অ্যানিমেল শেল্টার’ নামে একটি ফেসবুক পেজে পোষা প্রাণীদের প্রতিপালনের যাবতীয় তথ্য এবং প্রাণীদের ওপর নির্যাতন বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন তিনি।