মা যখন অফিসে
‘নারী শুধু ঘরের কাজ করবেন’ বর্তমানে এমন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটছে। তবে একথা অস্বীকার করার অবকাশ নেই নারী যতই আত্মনির্ভরশীল ও অর্থায়নের দিক থেকে সাবলম্বি হয়ে উঠুক তাকে আজও সংসারের চিন্তা করতে হয়। আদরের সন্তানকে ছেড়ে বাসায় রেখে এসে সারাবেলা অফসের কাজের ব্যাস্ততায় ভাবতে তার খাওয়া, গোসলের কথা।
এটি সত্য আধুনিক এ সময়ে এসে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ যেভাবে বেড়েছে, সে হারে বাড়েনি কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য অনুকূল অবকাঠামো। সে ক্ষেত্রে অন্যতম বড় একটি প্রতিবন্ধকতার নাম শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা ডে–কেয়ার সেন্টারের অপর্যাপ্ততা।
তাই তো এখনও কর্মজীবী মায়েরা তাদের শিশুসন্তানকে তাদের অনুপস্থিতিতে কোথায়, কার কাছে থাকবে, সেই জটিল প্রশ্নের উত্তরের জবাব খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছেন।
বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা করলে দাঁড়ায়, যেসব কর্মজীবী মা সন্তানকে বাসায় রেখে অফিস করেন, তাদের প্রায় সবার গল্পই একই রকম।
সন্তানকে সার্বক্ষণিক দেখভাল মায়ের মতো করার লোকের বড্ড অভাব। সংসারে যত মানুষই থাকুক না কেন, মায়ের মতো যত্ন কেউ নেবে না। আর যারা একক পরিবারে থাকেন, তারা যদি কাজের লোকের কাছে সন্তানকে রেখে কর্মক্ষেত্রে চলে যান তাহলে তো মায়ের দুশ্চিন্তা থেকেই যায়।
সেক্ষেত্রে বাসায় শিশুসন্তানকে রেখে অফিস করলে প্রায় সব মায়ের মনেই একটা অপরাধবোধ কাজ করে। এদিকে একা একা বাসায় থাকলে সন্তানের মনেও মায়ের প্রতি বাসা বাঁধে অভিমান।
এই সংকট সমাধানের উপায় –
১. বাসায় মা সব সময় কাছে না থাকলে সন্তানের মনে অভিমান হলে তার সঙ্গে রাগারাগি না করে সহজ ভাষায় বোঝাতে হবে। মাঝেমধ্যে সন্তানকে সঙ্গে করে অফিসে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। তাতে সে তার মায়ের কাজের পরিবেশ ও গুরুত্ব বুঝতে পারবে।
২. ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে স্বনির্ভর হতে শেখান। আপনার অনুপস্থিতিতে এতে ওর সুবিধা হবে। নিজের জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখা, নিজের হাতে খাবার খাওয়া, জামা-জুতা খোলা-পরা ওকে শেখান।
৩. শিশুর মানসিক সুস্থতা পরিবেশের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখুন। আপনার অনুপস্থিতিতে কোনো সমস্যায় যেন সবাই এগিয়ে আসতে পারে, তাই সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য ছুটির দিনে মাঝেমধ্যে সবার বাসায় বেড়াতে যান।
৪. সন্তানের স্কুল, বন্ধুর অভিভাবক, সন্তানের শিক্ষক, আপনার প্রতিবেশী সবার ফোন নম্বর সব সময় নিজের কাছে রাখুন, যাতে অফিসে বসেও যেকোনো প্রয়োজনে আপনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
৫. মাঝেমধ্যেই সন্তানকে ফোন করে তার খোঁজ-খবর নেবেন। ও যেন কখনো অনুভব না করে যে আপনি তাকে অবহেলা করছেন।
৬. সন্তানকে শেখান বাসায় একা থাকলে ও যেন কাউকে দরজা না খুলে দেয়। আপনার পরিচিত সবাইকে বলে দিন আপনার অনুপস্থিতিতে বাসায় না আসতে।
৭. বাসায় একটা ফোন ডায়েরি রাখুন। তাতে প্রয়োজনীয় সব নম্বর লিখে রাখুন।
৮. খুব বিশ্বাসী না হলে শিশুকে একা কাজের লোকের সঙ্গে বাসায় রাখবেন না। আপনার শিশু কাজের লোকের সঙ্গে থাকতে স্বছন্দবোধ করছে কি না, তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নজরে রাখুন।
৯. বাসায় একটা ফার্স্ট এইড বক্স রাখুন।
১০. বাসায় ফেরার পর ফ্যামিলি টাইমের সঙ্গে কোনো কম্প্রোমাইজ করবেন না। সন্তানের সঙ্গে সময় কাটান। ওর প্রতিদিন কেমন কাটল, কীভাবে কাটল তা জেনে নিন। ওর বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, শিক্ষকদের নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলুন। একসঙ্গে খাবার খান, টিভি দেখেন। ওর হোমওয়ার্ক করান।
১১. সন্তানকে ওর শখের কাজে উৎসাহিত করুন। অবসর সময়টা এতে ওর ভালো কাটবে।
১২. সন্তানকে সময় দিতে পারছেন না বলে উপহার দিয়ে সেই ক্ষতি পোষানোর চেষ্টা করবেন না। সময় দিতে না পারার জন্য মনে দুঃখবোধ কাজ করলে মাঝেমধ্যে ছুটির দিনের পুরোটা সময় ওকে দিন। আপনার সঙ্গই হবে ওর জন্য সেরা উপহার।
১৩. বাচ্চার মানসিক সুস্থতা অনেকটাই নির্ভর করে পারিবারিক পরিবেশের ওপর। যেহেতু আপনারা সব সময় তাকে সঙ্গ দিতে পারছেন না, সেজন্য বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি বা অন্য আত্দীয়স্বজনের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করুন যাতে কোনো ইমার্জেন্সিতে তাদের পাশে পেতে পারেন।
১৪. বাড়িতে একা থাকাকালীন বাচ্চাকে স্ট্রিক্ট ইনস্ট্রাকশন দিন সে যেন কাউকে দরজা খুলে না দেয়। আত্দীয়-স্বজন বা নিকট বন্ধু-বান্ধব সবাইকেই আগে থেকে আপনার অনুমতি নিয়ে আপনার অনুপস্থিতিতে আসতে বলুন। অতি পরিচিত হলেও বিনা অনুমতিতে ফাঁকা বাড়িতে না ঢুকতে দেওয়াই ভালো। বাড়ির দরজায় সঠিক উচ্চতায় আই হোল, ডোর চেন এবং ল্যাচের ব্যবস্থা রাখুন।
১৫. বাড়িতে একটা ল্যান্ড লাইন এবং একটা সেলফোন রাখুন যাতে একটা খারাপ হলে অন্যটা ব্যবহার করা যায়। টেলিফোন ডায়রিতে নিজেদের নম্বর, নিকটাত্দীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের এবং অন্যান্য ইমার্জেন্সি নম্বর পরিষ্কার করে টুকে রাখুন। যাতে ইমার্জেন্সিতে সে কাজে লাগাতে পারে।
১৬. বিশ্বাসী না হলে নতুন কাজের লোকের সঙ্গে বাচ্চাকে থাকতে দেবেন না। নতুন কাজের লোক বহাল করার সময় সে আগে যেখানে কাজ করত সেখানে খোঁজ নিন। কাজে যোগ দেওয়ার পর তার কাজকর্ম তত্ত্বাবধান করুন। দেখুন বাচ্চা তার সঙ্গে কমফর্টেবল বোধ করছে কি না।
১৭. বাচ্চা বাড়িতে লাঞ্চ বা খাবার যাই খাক, সেটা যেন গ্যাস জ্বালিয়ে না খেতে হয় সে দিকে খেয়াল রাখুন। মাইক্রোওয়েভ অভেন ব্যবহার করতে শিখিয়ে দিন বা আপনি আগে থেকে খাবার গরম করে রেখে দিন। গিজার, গ্যাস, ইলেকট্রিক ইস্ত্রির মতো গ্যাজেট ব্যবহার না করতে তাকে এনকারেজ করুন
নিজের জন্য করণীয় : প্রথমেই বলে রাখা ভালো, সন্তানকে বাড়িতে রেখে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো অপরাধবোধে ভুগবেন না। এ কথা সত্যি, ক্যারিয়ারের জন্য আপনাকে দিনের অনেকটা সময় অফিসকে দিতে হচ্ছে, কারণ সন্তান এবং ক্যারিয়ারের সমান গুরুত্ব রয়েছে আপনার জীবনে। আর ক্যারিয়ার মানে তো এই নয় যে, আপনি সন্তানকে অবহেলা করছেন। আপনার উপার্জন করা অর্থ সন্তানকে সুন্দরভাবে বড় করে তুলতে সহায়ক। এছাড়া আপনার ক্যারিয়ার আপনাকে যে মানসিক সন্তুষ্টি দেয়, তা আপনাকে একজন ভালো মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। আর একজন ভালো মানুষই তো একজন ভালো মা হতে পারেন, তাই না?