শিশুধর্ষণ ঠেকানোর উপায় কী
দেশে দিনে দিনে বেড়েই চলেছে শিশুধর্ষণের ঘটনা। শিশুরা পথেঘাটে যেমন, তেমনি বাসাবাড়িতেও আর নিরাপদ নয়। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা খেলার মাঠেও তারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কন্যাশিশুরাই কেবল নয়, ছেলেশিশুরাও ধর্ষকদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। অপরাধ বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও সমাজকর্মীরা বলছেন, পরিবারের সচেতনতার অভাব, শিশুদের গুড টাচ, ব্যাড টাচ সম্পর্কে সচেতন না করার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এজন্য তারা শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনারও সুপারিশ করেন।
শিশু ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে দেশের অপরাধ বিশেষজ্ঞ, বিচারক, শিক্ষক, আইনজীবী ও সমাজকর্মীর মুখোমুখি হয়েছে ‘পাক্ষিক অনন্যা’।
বরিশাল জেলা ও দায়রা জজ ইসরাত জাহান বলেন, ‘এখন নারী-পুরুষের মধ্যে পর্নোগ্রাফি দেখার প্রবণতা বেড়েছে। সেইসঙ্গে জন্ম নিচ্ছে বিকৃত মানসিকতারও। যা শিশু ধর্ষণের দিকে ধাবিত করছে অনেককেই। এক্ষেত্রে শুধু যে মেয়ে শিশুই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, এমনটা নয়; বরং ছেলে শিশুও ছাড় পাচ্ছে না। বিকৃত মানসিকতার কিছু মানুষ শিশু ধর্ষণ করছে, এর অন্যতম কারণ শিশুধর্ষণ করে পার পাওয়া সহজ। আর বর্তমানে বাবা-মা উভয়ই কর্মজীবী। ফলে শিশুরা পরিবারের সদস্যসহ পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে বেড়ে উঠছে। আশঙ্কাজনকভাবে প্রতিবেশী, অপরিচিত জন ছাড়াও শিশুরা পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় -স্বজনের দ্বারা অনেক বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এছাড়া নৈতিক অবক্ষয়, পর্নোগ্রাফির নিয়ন্ত্রণহীন বিস্তার, পারস্পরিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তাহীনতা, পতিতালয়গুলো তুলে দেওয়া সবই শিশু ধর্ষণের কারণ। এক্ষেত্রে আমি সমর্থন করছি না যে, সমাজে পতিতালয়গুলো থাক বা গজিয়ে উঠুক। কিন্তু জৈবিক চাহিদাকে তো অস্বীকার করা যায় না।’
শিশুধর্ষণের মতো অপরাধের জন্য শিক্ষকরা দায়ী করছেন মানসিক বিকৃতি, মাদক, ইন্টারনেটের যথেচ্ছ ব্যবহার, অপ-সংস্কৃতির প্রভাব, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, বেকারত্ব, কুসংস্কারকে।
শিশুধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধকে রুখার পরামর্শ দিয়ে এই বিচারক আরও বলেন, ‘প্রথমত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো জরুরি। কারণ এখন কো-এডুকেশন চোখেই পড়ে না। শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য পারস্পরিক যোগাযোগ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, যা একসঙ্গে বড় হলেই কেবল সম্ভব। বর্তমানে অনেক পরিবারেই একটি বা দুটি সন্তান থাকার কারণে দেখা যায় কোনো কোনো পরিবারে যেকোনো একটি লিঙ্গের সন্তান থাকে। ফলে অন্য লিঙ্গের প্রতি একটি আলাদারকম কৌতূহল জন্মে। একসঙ্গে বেড়ে উঠলে যেটা অনেকাংশেই পরিত্রাণ করা সম্ভব। সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।’

এই বিচারক আরও বলেন, ‘এক্ষেত্রে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি। অর্থনৈতিক নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা ও নৈতিকতা নিশ্চিত করলেও এ ধরনের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটবে। বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে, যেমন শুধু অপরাধী বা অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের নয় সেই সঙ্গে যারা ভিক্টিমকে বা তার পরিবারকে হেনস্তা করে, সামাজিকভাবে অপদস্থ করে তাদের ও আইনের আওতায় আনা উচিত। ধর্ষিত শিশুর প্রতি ডাক্তারদের মানবিক হতে হবে। ধর্ষণের শিকার কাউকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করা যাবে না। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’
শিশুধর্ষণের মতো অপরাধের জন্য শিক্ষকরা দায়ী করছেন মানসিক বিকৃতি, মাদক, ইন্টারনেটের যথেচ্ছ ব্যবহার, অপ-সংস্কৃতির প্রভাব, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, বেকারত্ব, কুসংস্কারকে।
এই বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খানম বলেন, ‘পৃথিবী সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ যে সব প্রবৃত্তির তাড়নায় ভুগছে, তার মধ্যে অন্যতম যৌনপ্রবৃত্তি। পেটের ক্ষুধা যেমন মেটানো প্রয়োজন, তেমনি শরীরের ক্ষুধা মেটানোও জরুরি। জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য মানুষ সামাজিক বা ধর্মীয়ভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু এই ক্ষুৎপিপাসা স্বীকৃতির বাইরে গেলেই তা অপরাধ। বর্তমানে সমাজের সবচেয়ে ঘৃণ্যতম এবং অমার্জনীয় অপরাধ ধর্ষণ। বিশেষ করে শিশু ধর্ষণ। দিনদিন তা বেড়েই চলেছে।’
এই শিক্ষক বলেন, ‘‘শিশু ধর্ষণের নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। বরং একাধিক কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মানসিক বিকৃতি। যারা শিশুধর্ষণ করে, তারা কেউই সুস্থ মানসিকতার নয়। বিকৃত রুচি ছাড়া ৬-৮ মাসের বাচ্চাকে কেউ ধর্ষণ করতে পারে না। যার ফল হয় শিশুটির মৃত্যু বা শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা। চিকিৎসা বিজ্ঞানও এই মানসিক বিকৃতিকে স্বীকার করেছে। যাকে ‘পিডোফোলিয়া’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিকৃত মানসিকতার পাশাপাশি মাদক, ইন্টারনেটের বহুল ব্যবহার, বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, কুসংস্কার সবই শিশু ধর্ষণের নেপথ্য কারণ। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কেউই দায় এড়াতে পারে না।’

রাবির এই শিক্ষক বলেন, ‘কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। শিশুকে Good-tauch, Bad-tauch সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। বাড়িতে অন্ধ বিশ্বাসে যে কারও অবাধ আনাগোনা বন্ধ করতে হবে। শিশুকে যেখানে-সেখানে যে কারও সঙ্গে বেরুতে দেওয়া যাবে না। বাবা-মাকে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। অন্যায়ের জোরালো প্রতিবাদ করতে হবে। এছাড়া আইনের মাধ্যমে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষার মাধ্যমে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তুলতে হবে।’
শিশুধর্ষণ বন্ধে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, অভিভাবকদের সচেতনতা। পাশাপাশি একটা স্বচ্ছ, দ্রুত ও কার্যকর বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।
শিক্ষক, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের মতে, শিশু ধর্ষণের জন্য অবহেলা করা, যথাযথ আইনের প্রয়োগ না হওয়া, থানা-পুলিশের কাজে গাফিলতি প্রধানত দায়ী। পাশাপাশি সমাজ, বাবা-মা ও অভিভাবকদেরও দায়ী করছেন।
জানতে চাইলে ‘পাক্ষিক অনন্যা’কে আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী দিলরুবা শারমিন বলেন, ‘আমরা শিশুদের ছোটবেলা থেকেই কেবল শিশু হিসেবেই বিবেচনা করি। তারা যে পুরুষ বা নারী লিঙ্গের একজন মানুষ, এটা ভাবতে ভুলে যায়। কিন্তু বিকৃত মানসিকতার যেসব মানুষ আছে, তারা শিশুর সারল্য, অসহায়ত্বের সুযোগটা কাজে লাগায়৷ নিশ্চিন্ত মনে বিনোদন পাওয়ার আশায় শিশু ধর্ষণ করে। কিন্তু আজকাল শুধু যে কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, এমনটা নয় বরং ছেলে শিশুও এ ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছে। শিশু ধর্ষণের পরিমাণ বাড়ার প্রধান কারণ আইন এবং বিচারব্যবস্থা। এছাড়া শিশুদের অবহেলা করা, যথাযথ আইনের প্রয়োগ না হওয়া, থানা-পুলিশের কাজে গাফিলতি পাশাপাশি সমাজ, বাবা-মা ও অভিভাবকরাও দায়ী। কারণ গার্জিয়ানরা মনে করেন না, শিশুরা সবার কাছে নিরাপদ নয়। খাওয়া-পরার সঠিক পরিচর্যা করলেও শিশু কার সঙ্গে থাকছে বা কার সংস্পর্শে যাচ্ছে সেটা অনেকেই আমলে নেন না। সাক্ষী-প্রমাণের অভাব, আইনের দীর্ঘসূত্রিতা, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা না থাকার ফলে গোটা রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্মীয় বিভিন্ন ব্যবস্থা, পরিবার কাউকেই ছাড় দেওয়া যাচ্ছে না।’

এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘শিশুধর্ষণ বন্ধে সবার সার্বিক সহযোগিতা জরুরি। শিশুদের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কথা বলতে হবে। শুনতে হবে তারা কী বলতে চায়। এছাড়া স্কুলে ধাপে ধাপে সচেতনতা বৃদ্ধিতে পড়াশোনার মধ্যে বিষয়গুলোকে স্থান দিতে হবে। পাশাপাশি শিশুবান্ধব পরিবেশ, ক্লাব, সংগীত-সাংস্কৃতিক অঙ্গন, শিশু বান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠা, শিশু বান্ধব থানা-পুলিশ, আইন-আদালত গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের উন্নয়নে বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে। শিশুদের স্পেশাল কেয়ারের ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুধর্ষণ বন্ধে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে সবার সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আইন-আদালত সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ; এই স্লোগানকে বাস্তবে রূপ দিলে শিশু ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, শিশু অপহরণ এগুলো কমে যেতে বাধ্য।’
এই প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নিয়ামুন নাহার বলেন, ‘আমার মনে হয়, মানুষ ভয়াবহ রকমের যৌন অবদমনে ভুগছে। সুতরাং,ধর্ষক কিন্তু আলাদা কোনো পরিচয় না কারও। যেকেউ যেকোনো মুহূর্তে ধর্ষক হয়ে উঠতে পারে। খেয়াল করলে দেখবেন, যারা ধর্ষণ করছে, তারা সারাজীবন ধরে ধর্ষণ করছে, এমনটা না। এদের পেশাগত কোনো নির্দিষ্ট ক্যাটাগরি নাই। গ্রাম-শহর, রাজধানী, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ, বাসচালক, যেকোনো বয়সের মানুষ যেকোনো মুহূর্তে ধর্ষক হয়ে ওঠে। যারা ধর্ষণে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রান্তিক অবস্থানে আছে শিশুরা। আমরা যখন এমন এক সোসাইটিতে বাস করি, যেখানে সেক্স একটা ট্যাবু, যে পরিবারের যে শিশুটি এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এবং বীভৎসতার শিকার হচ্ছে, সেই পরিবার পর্যন্ত লোকলজ্জায় ভোগে, কখনো ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চায়।’
এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘যেখানে সমাজের প্রায় সব মানুষই এখনো মনে করে যে, ধর্ষণের জন্য দায়ী হলো পোশাক, এই সমাজ ধর্ষণকে টিকিয়ে রাখতে চায়। একদম শিশুরা, যারা কথা বলার অবস্থায়ই নেই, তারা যেমন ঝুঁকিতে আছেন, তেমনি ঝুঁকিতে আছে, সব বয়সের শিশু। কখনো প্রাণ-সংশয় ঘটছে, কেউ সারাজীবনের জন্য ট্রমার শিকার হয়ে ভয়ানক জীবন যাপন করছে। এই সুযোগটা কিন্তু আমাদের সমাজই তৈরি করে দিয়েছে। এই যে ধর্ষণ নিয়ে কথা না বলা, ধর্ষণ কেন ঘটে, সেসব নিয়ে দোষারোপমূলক চিন্তা পদ্ধতি, যৌন অবদমন, এগুলোই শিশু ধর্ষণের বড় কারণ। ’

তিনি আরও বলেন ‘সমাজের মানুষ প্রচণ্ড রকমের যৌন অবদমনে ভুগছে। নির্দিষ্ট বয়সের পর নারী-পুরুষের মেলামেশায় সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় বাধা না থাকলে, নারী-পুরুষের মেলামেশা সহজ হলে ধর্ষণ বিপুলভাবে কমে যেতো। এ সমাজে নারী-পুরুষ একে অপরের অচেনা।’ তিনি বলেন, ‘যে শিশুদের বয়স সাত, আট বা তারচেয়ে বেশি, তারা জানে না বা বলা ভালো তাদেরকে জানতে দেওয়া হয় না যে সেক্স আসলে কী। অর্থাৎ, যৌনতা কী, যৌনতা কেন স্বাভাবিক, ইত্যাদি। এই দায়িত্ব নিতে পারে পরিবার ও রাষ্ট্র। কিচ্ছু না জেনে, যারা ধর্ষণের শিকার হয়, সেই শিশুরা পরিবারকে বলতে পর্যন্ত পারে না, তাদের সঙ্গে কী ঘটেছে।’
এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগেই আমরা জেনেছি, ১৩ বছর বয়সের একজন শিশু আত্মহত্যা করে ধর্ষণের পরে। যার জীবন সম্পর্কে কোনো বাস্তব ধারণা এখনো পোক্ত হয়নি, সে শিশুও জানে যে ধর্ষণ এমনই লজ্জার যে তাকে আত্মহত্যা করতে হবে। তার মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা কেমন করে এলো? সমাজের এবং রাষ্ট্রের বহু চর্চিত, মুখস্থ আইডিয়াগুলো এসে পড়েছিল শিশুটির ওপরে। সুতরাং, সেক্স এডুকেশন, গুড টাচ, ব্যাড টাচ ইত্যাদি শিক্ষা যদি একদম ৪ বছর বয়স থেকে শিশুরা পেতো, পরিবার ও সমাজের মানুষ যদি সহনশীলতার সঙ্গে ধর্ষণকে ডিল করতে পারতো, তাহলে শিশু ধর্ষণ কমে যেতো।’
শিশু ধর্ষণ বন্ধে পদক্ষেপ প্রসঙ্গে এই শিক্ষক বলেন, ‘‘পারিবারিক সাপোর্ট ও সবার ওপরে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ সবচেয়ে জরুরি এই মুহূর্তে। সেক্স এডুকেশন পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করার এটাই সময়। সেক্স এডুকেশন সম্পর্কে আমাদের মিডিয়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ছোটো ছোটো শিক্ষামূলক ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করে বারংবার আমাদের মিডিয়াগুলোতে দেখানো দরকার। পত্র-পত্রিকায় ‘পড়াশুনা’র পাতায় ছোট ছোট সতর্কতামূলক, একইসঙ্গে সহজে বোঝা যায়, এমন কন্টেন্ট প্রচার করা দরকার। শিশু ধর্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখা এবং প্রচুর লেখালেখি হওয়া দরকার।
ধর্ষণের পর শিশু ভয়াবহ ট্রমায় আক্রান্ত হয়, তার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যায়। এজন্য ধর্ষককে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে যায়। ধর্ষক শিশুর এইসব অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে নিজের বেঁচে যাওয়ার গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে চায়। তাই খুব নির্দিষ্টভাবে ঠাণ্ডা মাথায় সে শিশুকে তার লক্ষবস্তুতে পরিণত করে।
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা ব্র্যাক-এর জেন্ডা অ্যান্ড ডাইভার্সিটি প্রোগ্রামের রিজিওনাল ম্যানেজার মাহেরা বিনতে রফিক বলেন, ‘শিশু ধর্ষণের পেছনে ন্যাক্কারজনক ও মর্মান্তিক কারণ আছে। বিকৃত মানসিকতা ছাড়া আর কিছুকেই এর জন্য দায়ী করা যায় না। শিশুর ওপর জোর খাটানো সহজ। অনেক সময়েই খুব কাছের মানুষ দ্বারা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এক্ষেত্রে তাকে প্রভাবিত করা সহজ, তার জানার সীমাবদ্ধতা এবং বিশ্বাসের সুবিধা নেওয়া সহজ। অধিকাংশ সময়েই শিশুটি ধর্ষণের পর ভয়াবহ ট্রমায় আক্রান্ত হয়, তার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যায়। এজন্য ধর্ষককে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে যায়। ধর্ষক শিশুর এইসব অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে নিজের বেঁচে যাওয়ার গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে চায়। তাই খুব নির্দিষ্টভাবে ঠাণ্ডা মাথায় সে শিশুকে তার লক্ষবস্তুতে পরিণত করে।’

মাহেরা বিনতে রফিক আরও বলেন, ‘‘আমরা কখনোই শিশুধর্ষণের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স পলিসি নিতে পারিনি। না হয়েছে ব্যাপক সামাজিক প্রচার প্রচারণা, না তৈরি হয়েছে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার উদাহরণ, না আমাদের অভিভাবকদের পেরেছি যথেষ্ট সচেতন করতে। ধর্ষণ, গুড টাচ, ব্যাড টাচ বিষয়গুলো এখনো ট্যাবু হয়ে আছে, ‘এগুলো বাচ্চাদের জানার বিষয় না’ বলে আমরা তাদেরই বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। অভিভাবকদের বাচ্চাকে যথেষ্ট সময় না দেওয়া, সতর্ক না থাকা ও শিশুর সঙ্গে খোলামেলাভাবে এসব বিষয়ে আলাপ না করার কারণেও একই ঘটনার সূত্রপাত হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে সবাই কী বলবে, মান সম্মান থাকবে না; এসব ভেবে শিশুর পরিবার মুখে রা করে না। আবার করলেও দীর্ঘ প্রক্রিয়ার হয়রানি, ধর্ষক প্রভাবশালী ব্যক্তি হলে তার হুমকি, একটা করাপ্টেড সিস্টেমের নিচে নিষ্পেষণের কারণে সমাজে মহামারীর মতো বেড়ে চলেছে শিশুধর্ষণ।’
এই ব্র্যাক কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘শিশুধর্ষণ বন্ধে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, অভিভাবকদের সচেতনতা। পাশাপাশি একটা স্বচ্ছ, দ্রুত ও কার্যকর বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।’
ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী ও লেখক শেখ কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে শিশুধর্ষণ খুবই আলোচিত একটি বিষয়। ক্রিমিনলোজি বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, অপরাধীর কিছু চারিত্রিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য থাকে। মানসিক দিক যদি আমরা বিবেচনা করি, তা হলো তার গিল্টি মাইন্ড; যা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আর অপরাধীর এই গিল্টি মাইন্ড শিশুদের ক্ষেত্রেই বেশি কাজ করে। কারণ শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক দুর্বল থাকে,প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থাকে না। সব কথা খুলে বলতে পারে না, অনেক কিছু বোঝে না। দিনের পর দিন ধর্ষণের শিকার হয়েও তারা চুপ থাকে। অনেক সময় এই বিষয় নিয়ে ট্রমায় চলে যায়। তাই শিশুরাই বেশি শিকারে পরিণত হয়।’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘বাবা-মায়ের এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব, সামাজিক দায়িত্বহীনতাও এজন্য দায়ী। সমাজে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে এই দায়টা কারও একার নয়, দায়টা আমাদের সবার। সামাজিক অবক্ষয়, অসচেতনতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা,নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাব,আইনের সঠিক বাস্তবায়ন, পারিবারিক অনুশাসন এসবই শিশু ধর্ষণের জন্য দায়ী। শিশু ধর্ষণ প্রতিরোধে সবার আগে আমাদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।’

কানিজ ফাতেমা আরও বলেন, ‘‘অনেক শিশু পরিবারের খুব কাছের মানুষের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়। এই বিষয়েও শিশুদের পারিবারিকভাবে সচেতন করে তুলতে হবে, ‘গুড টাচ’, ‘ব্যাড টাচ’ সম্পর্কে তাদের সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা কমানো, এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইনের সুষ্ঠু ব্যবহার,সামাজিক ও পারিবারিক অনুশাসনের মাধ্যমে আমরা শিশু ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে পারি।’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ব্যক্তিগত জায়গা থেকেও আমাদের সবার ধর্ষণ প্রতিরোধে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ সামাজিক মূল্যবোধ বলতে আমি,আপনি, আমরা বা আমাদের সুষ্ঠু চিন্তার প্রতিফলনকেই বোঝায়।’
অনন্যা/এআই