উচ্চশিক্ষায় গ্রামীণ নারীদের চ্যালেঞ্জ
নারীরা আজ সর্বত্র বিচরণ করছেন। একুশ শতকের এই প্রান্তে এসে শিক্ষা, কর্মজীবন, সংসার সবকিছুতে সব্যসাচীর রূপে অবতীর্ণ হয়েছে তারা। তবে এই এগিয়ে যাওয়ার মাঝেও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। যেমন গ্রামীণ পর্যায়ে নারীর অবস্থা আগের তুলনায় বেশ উন্নত হলেও এখনো নানা বিষয়ে পশ্চাৎপদতা দেখা যায়। এর পেছনের উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে উচ্চশিক্ষায় গ্রামীণ নারীদের পিছিয়ে থাকাকে।
শিক্ষার প্রভাব রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র একক পরিবার থেকে বিশ্বপরিমণ্ডলে বিস্তৃত। বাংলাদেশে শিক্ষার হার প্রতিনিয়ত বাড়লেও সে অনুযায়ী গ্রামের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে আছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিক্ষা কার্যক্রম অনেকাংশে নিশ্চিত করা সম্ভব হলেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রামের ছাত্রীরা এখনো অনেকটা পিছিয়ে। দেশের উন্নতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিবেচনায় গ্রামের নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে পড়ার হার অনেক বেশি শহরের তুলনায়।
উচ্চশিক্ষার অগ্রযাত্রায় গ্রামের নারী শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত হতে না পারার পেছনে বহু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তবে প্রথম ব্যাপার হচ্ছে, গ্রামীণ সমাজে নারী বৈষম্যমূলক প্রগাঢ় চিন্তাভাবনা। প্রান্তিক সমাজের বেশির ভাগ পরিবারসমূহে ভাবা হয় মেয়েরা ঘরের শোভা। কেবল সাক্ষর কিংবা সন্তানাদিকে অক্ষরজ্ঞান দিতে পারার সক্ষমতাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে নারীর শিক্ষা অর্জন মাধ্যমিকেই সমাপ্ত হয়। দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কুসংস্কারের প্রভাব বিরাজমান। কিছু পরিবারের আর্থিক সংগতি থাকলেও ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার, অবরোধপ্রথা ইত্যাদির জন্য মেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষায় উৎসাহী করা থেকে বিরত রাখে।
একবিংশ শতাব্দীর এই লগ্নে এসেও বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে মেয়েদের ১৮ বছরের পূর্বে সাবালিকা হলেই বিয়ে দেওয়া হয়। আর বিয়ের পরে পড়াশোনা চলমান থাকে, এমন শিক্ষার্থী খুবই কম। প্রায়শই স্বামীদের উদার মন-মানসিকতার অভাবে নারীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয় না।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীদের উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব শীর্ষক তথ্যের অভাব রয়েছে। আমাদের দেশে আনাচকানাচ এমন অনেক গ্রাম আছে, যারা জানেনই না যে, নারীদের উচ্চশিক্ষার জায়গা কতটা সুপ্রশস্ত। যার দরুন তারা মেয়ে সন্তানকে শুধুই গৃহস্থালি কাজে পারদর্শী করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
অনেক ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর স্কুল-কলেজে উৎসাহমূলক সরকারি সহায়তা পেলেও এরপর উচ্চশিক্ষা অর্জন প্রক্রিয়ায় ভীষণ বেগ পোহায়। উচ্চ মাধ্যমিকের পর কোচিং করানো কিংবা হোস্টেলে রেখে পড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক অভিভাবক আর্থিক অভাবে পিছিয়ে যান এবং নিরাপত্তা নিয়েও দ্বিধায় থাকেন।
গ্রামীণ নারীদের ব্যাপক হারে শিক্ষার প্রসার, সচেতনতা এবং বৃত্তিমূলক পেশায় নিয়োজিত করতে পারলে তাদের আর্থিক সচ্ছলতা বাড়বে, বাড়বে পরিবারে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং সেই সঙ্গে তাদের সন্তানরা পাবে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ। তাই শহরে নারীরা সবক্ষেত্রে যেমন এগিয়ে আছে, গ্রামীণ নারীদেরও সেভাবে উদ্বুদ্ধ করে তাদের জন্য সেই সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে।
এজন্য গ্রামে নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় উৎসাহী করা এবং উপস্থিতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। নারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে প্রচলিত ধ্যানধারণা থেকে বের হয়ে একটি সুস্থ ও অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ দূর করার লক্ষ্যে কঠোর আইন বাস্তবায়িত করতে হবে। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষায় সরকারি সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে, তবেই উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ সর্বোচ্চ হবে।