রেহানা ও পিংকি: সমাজের যাঁতাকলে
রেহানা মারিয়াম নূর চলচ্চিত্রটি যারা দেখেছেন, তারা বুঝতে পারবেন বাংলাদেশে যৌন-হয়রানি ও মানসিক হয়রানি এখন কোন পর্যায়ে আছে। তেমনই একটি দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায়।
রেহানা মারিয়াম নূরে যখন একজন নারীকে যৌন-হয়রানি করা হয়, তখন তিনি অভিযোগ করতে যান ও প্রতিষ্ঠানের সাহায্য আইনগত ব্যবিস্থা নিতে যান। কিন্তু তার অভিযোগ আমলে নেওয়া হয় না । বরং তাকে নানাভাবে সমঝোতা করার প্ররোচনা দেওয়া হয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন-হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ করেছেন, সেই শিক্ষকেরই একজন সহকর্মী। অভিযোগের দশ মাস পর্যন্ত এই বিষয়টি তারা আমলেই নেননি। যৌন-নিপীড়ন নিরোধ কমিটি বলেছে, ক্যাম্পাসের বাইরের ঘটনাকে তারা বিবেচনাই করেননি। তাছাড়া মানসিক ও যৌননিপীড়নের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
রেহানা মারিয়াম নূর চলচ্চিত্রের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে না? রেহানা যখন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটক শুনানি অবশেষে গঠন করতে পারে, তখন তাকে কমিটির সঙ্গে একটা মুখোমুখি শুনানিতে বসতে হয় । সেখানে তিনি যখন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেন না, তখন সেখানে অভিযোগকে সঠিক হিসেবে বিবেচনা করাই হয় না।
বরং প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নিজে একজন নারী হওয়ার পরও রেহানাকে উপদেশ দেন এই অভিযোগ তুলে নিতে। কারণ রেহানার নিজের একজন কন্যা সন্তান আছে। ভবিষ্যৎ আছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকের ওপর যৌন-হয়রানির অভিযোগ উঠে এসেছে, তিনি সাময়িকভাবে বরখাস্ত হন বটে কিন্তু পরবর্তী সময়ে আবার তিনি সমসম্মানের নিজের কর্মস্থলে ঠিকই ফিরে আসেন ।
এ বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক মহলে একটি বিরূপ প্রতিস্ক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘যৌন-হয়রানি ও নিপীড়নের নিরোধ নীতিমালা-২০০৮’ অনুযায়ী, কোনো বিষয়ে তদন্ত না হলে বা সে বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রমাণ না থাকলে সেটা সাত কার্যদিবসের মাঝে জানানো আবশ্যক। সর্বোচ্চ ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও কেন পাওয়া যায়নি, সেটা নিয়েই মূলত শিক্ষকদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
কিন্তু অভিযোগকারী জানিয়েছেন , এই বিষয়ের প্রমাণ স্বরূপ কিছু তথ্য, যেমন, শিক্ষকের ক্ষমা চেয়ে কল রেকর্ড, এস এম এস কমিটিকে দেওয়া হয়েছে কিন্তু কমিটির মতে সেই প্রমাণ যথেষ্ট নয়।
রেহানা মারিয়াম নূর ও যার বিরুদ্ধে তিনি অভিযগ করেছেন, তারা একই প্রতিষ্ঠানের সহকর্মী ছিলেন। দুজনেই সব অধিকার সমান সমান ভাবে পাওয়ার কথা একটা প্রতিষ্ঠান থেকে, কিন্তু যৌন-হয়রানির ক্ষেত্রে পুরুষেরা পার পেয়ে গেছেন সর্বত্রই। নারীদের অভিযোগ করার থাকলে বা করতে ইচ্ছা করলেই একজন নারী যথা সময়ে বিচার পান না। এছাড়া, নারী যখন যৌন-হয়রানির শিকার হয় তখন নারীর হয় কলংকের দোষ।
পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নারীকেই আড়চোখে দেখে বিচার করা হয়, দোষী সাব্যস্ত করা হয় । এইজন্য নারীরা অভিযোগ করতেও ভয় পান। কী হবে অভিযোগ করে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা সারা বাংলাদেশের অনেক ঘটনারই প্রতীক। এ কারণে খুব কম নারীই থাকেন, যারা ন্যায়বিচার পান, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পান না।
নারীদের যৌন-নিপীড়নের জন্য আইন প্রয়োগে লিখিত ব্যবস্থা আছে ঠিকই কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রেই হয়তো ঝামেলা। তাই নারী যখন কোনো অভিযোগ আদালতে করে, তখন সেটা দ্রুত উপায়ে কার্যকর করার ব্যবস্থা আছে। সেটা হলো অলতারনেটিভ ডিসপিউট রেজুলিউশন অর্থাৎ এডিআর । এডিআরের মাধ্যমে যেকোনো মামলার নিষ্পত্তি অনেক দ্রুত হয়।
দিন দিন যৌন নির্যাতনকারীরা বিভিন্নভাবে পার পেয়ে যায়। আর এই কারণেই তারা একজন অপরাধী হওয়া স্বত্তেও গর্বের সঙ্গে রাস্তায় চলাফেরা করতে পারে। আর এটা দেখে আরও নতুন অপরাধী জন্ম নেয়। গোটা সমাজের এই যৌন হয়রানিকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রতিদিন হাজারো হেনস্তাকারী জন্ম নিচ্ছে ।কারণ সবাই জানে যেখানে সাধারণ যৌনশিক্ষা নেই, সেখানে যৌন-হয়রানি নিয়ে কথা বলতে কারও বোঝারও কথা নয়।