নারীকে কেন পুরুষ বোঝা মনে করে
নারীর জীবনযাপন সহজ নয়! তা সে পরিবারে হোক বা সমাজে। নারীকে পরিবার থেকে সমাজ কোথাও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে না। এখনো অনেক পরিবার আছে, যেখানে কন্যাসন্তান জন্মালেই নাক সিটকায়। আবার এমন অনেক পরিবারও আছে, যেখানে কন্যাসন্তানের আগমণবার্তা শোনা মাত্রই সেই ভ্রূণ নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। এক্ষেত্রে কন্যাসন্তানের জন্ম পৃথিবীতে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা খুব কম মানুষের। নারীর জন্মই বাধাবিপত্তির মধ্যে! জন্মের পর তাই নারীরা আরও অনিরাপদ জীবনযাপন করে। নারীকে বোঝা মনে করা হয় বলেই পরিবার, সমাজ নারীর প্রতি এমন বিরূপ আচরণ করে। কিন্তু নারীকে কেন বোঝা মনে করা হয়?
এক্ষেত্রে বাঙালি জাতির একটি অভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার পরিলক্ষিত হয়! বাংলাদেশের নিরানব্বইভাগ পরিবার নারীকে বোঝা মনে করে। কারণ এর তারা মনে করে মেয়েকে পড়ালেখা শিখিয়ে ভালোমতো মানুষ করা অকারণ। একটা সময় মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দিতে হবে। আর যা নিজেদের জন্য নয়, সেখানে অর্থ ঢালা বা তার পেছনে বাড়তি সময় ব্যয় করাকে লোকসান মনে করে পরিবার।
বাংলাদেশর অধিকাংশ পরিবার নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত। তাই তাদের জীবনের হিসাবগুলো তারা খুব সচেতনভাবে করে থাকে। মেয়ের জন্য যে টাকা বা সময় খরচ করবে পরিবার, তার ভবিষ্যৎ কী, এই প্রশ্ন বাবা-মা করেন। কেউ কেউ হয়তো ব্যতিক্রম আছেন, তবে সংখ্যায় অত্যাল্প। কিন্তু আবহমানকাল ধরে বেশিরভাগেরই মানস গঠন এভাবে হয়ে এসেছে। ফলে তারা মেয়ের জন্য যেটুকু নির্ধারণ করে রাখে, সেটাই বাড়তি পাওয়া বলে মনে করে পরিবারগুলো। বাবা-মায়ের বৃদ্ধ বয়সে ছেলে সন্তান তাদের ভার নেবে কিন্তু মেয়ে তো পরের বাড়ির আমানত। চলে যাবে পরের বাড়ি। তাহলে কেন বৃথা সময় ও অর্থব্যয় তার পেছনে? পরিবারের এ ধরনের মানসিকতা নারীর জীবনকে হুমকির সম্মুখীন করে। নারী তার জীবনে অস্তিত্ব সংকটে ভোগে। জীবনকে এলোমেলো করে তোলে। ফলে তার শারীরিক-মানসিক দুই দিকেই ক্ষতি হয়।
পরিবারের এই মানসিকতা সমাজেও বিদ্যমান। গ্রাম-গঞ্জে মুখে মুখে শুনতে পাওয়া যায়, আরে মেয়েকে এত পড়িয়ে-শিখিয়ে কী হবে ? সে তো অন্যের ঘর আলো করবে! টাকা পয়সাও অন্যই ভোগ করবে। বরং মেয়ের পেছনে যে টাকা খরচ করবে, তা দিয়ে ছেলেটাকে একটা ভালো স্কুলে দাও। তাহলে বংশ মর্যাদা রক্ষা হবে। বুড়ো বয়সেও চিন্তা থাকবে না। এই মানসিকতার কারণে নারীর জীবন আজও বোঝা পরিবারে-সমাজে।
নারীকে পরিবার-সমাজ বোঝাতে চেষ্টা করে তুমি অন্যের তাই পরিবারে তোমাকে কম খেতে হবে, কম পরতে হবে, কম চাইতে হবে! নারীও পরিবার, সমাজের শেখানো-শোনানো বুলি শিরোধার্য করে আজীবন তার গ্লানি বয়ে বেড়ায়। কিন্তু পরিবার থেকে যদি এই চিন্তার পরিবর্তন ঘটানো যায়, তবে দেখা যায় সমাজে সমতা বিদ্যমান। একটি পরিবারে একটি ছেলে, একটি মেয়ে থাকলে তিনি যদি তার সন্তানকে সুষ্ঠু শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেন, বিবেকসম্পন্ন করে তোলেন, তবে অন্যের যে কন্যা সন্তানটি তার ঘরে আসবে, সেও তাই হবে। তাই যদি পরিবারগুলো এ ধরনের হিসাব না কষে বরং ভালোবাসা মমতায় আগলে রাখেন, তবে নারীকে বোঝা মনে হবে না। বরং নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র।
বাবার পরিবারে যেমন একজন মেয়ে অবহেলিত, বোঝা মনে করা হচ্ছে তেমনি স্বামীর পরিবারেও তার ব্যত্যয় ঘটছে না! নারীরা যদি বাইরে কিছু টাকা উপার্জন করে, তবে তার মূল্য কিছুটা এলেও যেসব নারী গৃহকর্মে নিযুক্ত থাকেন, তাদের সম্মান আজও অধিকাংশ পরিবার দেয় না। কিন্তু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সংসারে পুরুষের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণ, ভূমিকা ও অবদান বেশি।
নারীকে কোথায় সম্মান দেওয়া হয়! নারীর প্রতি কখন ন্যায় করে পরিবার-সমাজের মানুষেরা! নারীকে যে পুরুষ জাতি বোঝা মনে করে, তার ভুরি ভুরি প্রমাণ দেওয়াই যেতে পারে! কিন্তু নারীও পুরুষের মতো মেধা, মনন, শক্তির অধিকারী। তবুও পুরুষের মজ্জায় আজও গেঁথে আছে বর্বরতার চিহ্ন! বেশিরভাগ পুরুষ স্ত্রীর সঙ্গ ত্যাগ করে ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করে। যদি প্রশ্ন করা হয়, তবে তাদের কাছে অভিন্ন একটা উত্তর রেডি করা থাকে। নারীরা বোঝা-ঝামেলা! টেনে নিয়ে বেড়ানো কষ্ট! কিন্তু এটা একবারও বিবেচনা করে না যে, নারী তার হাত-পা-মস্তিষ্ক দিয়ে নিজেকে চালিত করে! নারীকে বোঝা নয় বরং সহযোগী মনে করলে পরিবার ও সমাজের এ ধরনের বদ্ধমূল ধারণার পরিবর্তন ঘটবে। এই স্বাভাবিক বোধ যদি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে সঞ্চালিত হয়, তাহলে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সহায়তামূলক মনোভাব গড়ে উঠবেই। এছাড়া সমাজ উন্নয়নের কোনো গত্যান্তর নেই!
অনন্যা/জেএজে