Skip to content

স্মৃতির সিন্দুকে গাঁথা যেসব প্রজন্ম

স্মৃতির সিন্দুকে গাঁথা যেসব প্রজন্ম

একটা সময় ছিল, যখন সন্ধ্যা নামলেই ঘরের সবাই একসঙ্গে বসে পড়ত টেলিভিশনের সামনে। তখন ঘরে ঘরে একটাই চ্যানেল-বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, কিংবা ফেসবুকের স্ক্রলিং তখন ছিল কল্পনারও বাইরে ছিল।

এই প্রজন্মের তরুণদের কাছে সেই সময়টা আজ যেন রূপকথার মতো শোনায়। কিন্তু তবুও, আমাদের শেকড় যেখানে গাঁথা, সেই যুগঞ্জের কথা মনে রাখা- নতুন প্রজন্মের সঙ্গে শেয়ার করাটা সময়ের দাবি।

চলুন জেনে নেই সেই সময়টার গল্প-

ছবি- ইউফোরিয়া হুইসপার

ছবিতে যাঁকে দেখা যাচ্ছে, তিনি একজন জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনমুখ ছিলেন। যিনি ৮০ ও ৯০ দশকে বিটিভির নানা পণ্যের বিজ্ঞাপনে অংশ নিতেন। তিনি সম্ভবত ‘Tibet Snow’ বা অনুরূপ কোনো বিউটি ক্রিম বা কসমেটিক্স পণ্যের বিজ্ঞাপন করছেন।

এ ধরনের বিজ্ঞাপনগুলো সেই সময় টেলিভিশন বিনোদনের অন্যতম অংশ ছিল। “Tibet”, “Meril”, “Keya”, “Fair & Lovely” ইত্যাদি পণ্যের ক্লাসিক বিজ্ঞাপন তখন অনেকেরই মনে গেঁথে আছে। প্রচারের ভঙ্গি, সুর, ও উপস্থাপনার ধরন ছিল একেবারে আলাদা এক সময়ের স্মৃতি।

এই ছবিটি বিটিভির একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের-সম্ভবত কোনো বিশেষ দিবসের বা নতুন বছরের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা নৃত্যগীতি পরিবেশনা-এর সময় তোলা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একঝাঁক উপস্থাপক বা শিল্পী, যাঁরা ঐ সময়ের নামকরা মুখ ছিলেন। তাঁদরে পরনে শাড়ি ও সযুট-যা সঙ্গেই সময়ের স্টাইল ও উপস্থাপন ভঙ্গরি পরিচয় বহন করে।

এটি হতে পারে বিটিভির “নতুন বছর বিশেষ অনুষ্ঠান”, “বর্ণমালা” বা “আনন্দমেলা”-র মতো কোনো গানের পরিবেশনা পর্বের দৃশ্য। মঞ্চের সেট ডিজাইন, আলো এবং শিল্পীদের সাজপোশাক সবকিছুই সেই ক্লাসিক বিটিভি আমলের পরিচয় বহন কর, যখোন শালীনতা, রুচিশীল ও উপস্থাপনার পরিপূরণতা ছিল।

২০০৫ সালের কনকা টিভির “সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সুখ” বিজ্ঞাপনটি ছিল বেশ জনপ্রিয়। সাধারণ পারিবারিক আবহে, শিশুদের নির্মল হাসি আর এই শক্তিশালী স্লোগান মানুষের মন ছুঁয়েছিল। এটি মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে পারিবারিক সুখের আকাঙ্ক্ষাকে দারুণভাবে তুলে ধরেছিল বিজ্ঞাপনটি কেবল পণ্যের প্রচার নয়, বরং একটি সময়ের আবেগ ও জীবনবোধের প্রতিচ্ছবি।
আজও এটি অনেকের কাছে সোনালী অতীতের স্মৃতি আর সফল বিজ্ঞাপনের উদাহরণ।

আপনাকে একটি ছবি দেখানো হলো – সময়টা ১৯৯৬ সাল। ঝকঝকে এইচডি স্ক্রিন নয়, বরং কিছুটা অস্পষ্ট, অ্যানালগ সম্প্রচারের আবছা স্মৃতি মাখা একটি দৃশ্য। বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) সুপরিচিত নীলচে পর্দায় খবর পড়ছেন একজন উপস্থাপিকা – রওশন মোস্তফা শাওন। তাঁর চোখেমুখে স্থিরতা, উচ্চারণে স্পষ্টতা আর ব্যক্তিত্বে একধরনের সৌম্য গাম্ভীর্য।

পুরো পরিবার একসাথে বসে রাতের সংবাদ দেখা ছিল দৈনন্দিন রুটিনের অংশ। সেখানে রওশন মোস্তফা শাওনের মতো উপস্থাপিকাদের শান্ত ও পরিশীলিত উপস্থাপনা সংবাদের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলত।

ছবিতে উপস্থিত উপস্থাপিকার নাম নিমা রহমান। তিনি মূলত দুই হাজার দশকের শুরুতে স্থাপনা করতেন। তার উপস্থাপকের ধরন ছিল সামাজিক আলোচনা মনস্তাত্ত্বিক বিষয় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও নারীর স্তর তুলে ধরা।

অনুষ্ঠানটি প্রচারণা করা হত একুশে টেলিভিশন চ্যানেল থেকে। এটি একটি টকশো ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল। যেখানে সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা হতো। আর এটি একটি নারী নির্ভর টক শো ছিল।

এই অনুষ্ঠানের দর্শক চিঠি বা ফোনের মাধ্যমে প্রশ্ন করতে পারতেন এবং উপস্থাপিকা অনেক সময় দর্শকদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন বা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করতেন।

তোমারই বসন্ত দিনে’ ও নব্বইয়ের নস্টালজিয়া ১৯৯৭ সালে বিটিভির পর্দায় ভেসে ওঠা ‘তোমারই বসন্ত দিনে’ নাটকের দৃশ্য, যেখানে বিপাশা হায়াত ও তৌকির আহমেদ—এই জুটি মুহূর্তেই আমাদের নব্বইয়ের দশকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তখন বিটিভিই ছিল পারিবারিক বিনোদনের কেন্দ্র, আর সাপ্তাহিক নাটকগুলো ছিল দর্শকদের হৃদয়ের স্পন্দন, যা এক অন্যরকম আবেদন সৃষ্টি করত।

তোমারই বসন্ত দিনে’-এর মতো নাটকগুলো কেবল নিছক বিনোদন ছিল না, ছিল সেই সময়ের সমাজ, সম্পর্ক আর আবেগের প্রতিচ্ছবি। পুরো পরিবার একসাথে বসে এই নাটক দেখার স্মৃতি অনেকের কৈশোর বা তারুণ্যের সোনালী অধ্যায়ের সাথে জড়িয়ে আছে। আজ হঠাৎ সেই নাটকের কোনো দৃশ্য বা সংলাপ কানে এলে বুকের গভীরে এক মিষ্টি বেদনার মতো নস্টালজিয়া জেগে ওঠে। এই নাটকগুলো তাই আমাদের কাছে শুধু পুরনো দিনের স্মৃতি নয়, বরং হারিয়ে যাওয়া সুন্দর সময়ের এক অমূল্য দলিল।

ফিলিপস বাল্বের সেই নস্টালজিয়া পুরনো দিনের ফিলিপস বাল্বের বিজ্ঞাপন হঠাৎ চোখে পড়লে মুহূর্তে মন চলে যায় সেই সময়ে, যখন এই আলো ছিল ঘরের নির্ভরযোগ্যতার প্রতীক। বিজ্ঞাপনের সেই পরিচিত মুখ, কিংবা “বাহ! কী উজ্জ্বল আলো, সবকিছু ঝকঝক করছে” ধরনের সংলাপ যেন এক লহমায় ফিরিয়ে আনে ফেলে আসা দিনের ছবি।

ফিলিপস বাল্ব তখন শুধু আলো দিত না, দিত আস্থার উষ্ণতা, যা প্রতিটি পরিবারের কাছে ছিল অমূল্য। এই বিজ্ঞাপনগুলো ছিল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ, যা সহজ-সরলভাবে গৃহস্থালির অপরিহার্য একটি উপাদানকে তুলে ধরত। তখনকার দিনে ঘরে ফিলিপসের আলো জ্বলাটা ছিল একটা নিশ্চিন্তির ব্যাপার, যা আজকের LED-এর যুগেও অনেকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

প্রাণ বাবল গামের সেই পুরনো দিনের নস্টালজিয়া ২০০৪ সালের প্রাণ বাবল গামের বিজ্ঞাপনটি হঠাৎ চোখে পড়লে অজান্তেই মন চলে যায় হারিয়ে যাওয়া শৈশবের রঙিন দিনগুলোতে। বিজ্ঞাপনের সেই ছোট্ট মেয়েটির মুখে ফোলানো বাবলের দৃশ্য আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় এক অন্যরকম ভালো লাগার সময়ে।

তখন হয়তো নতুন স্কুল, বন্ধুদের সাথে খুনসুটি আর বিকেলের খেলাই ছিল জীবনের মূল আকর্ষণ, আর প্রাণ বাবল গাম ছিল সেই আনন্দেরই সঙ্গী।

জ্ঞাপনের সুর বা দৃশ্যগুলো যেন টাইম মেশিন হয়ে আমাদের সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে ক্ষণিকের জন্য হলেও ভ্রমণ করিয়ে আনে। এভাবেই কিছু বিজ্ঞাপন শুধু পণ্যের প্রচারেই সীমাবদ্ধ থাকে না, হয়ে ওঠে আমাদের বেড়ে ওঠার সোনালী স্মৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।