নারীর উচ্চশিক্ষার পথে এত বাধা কেন
নারীকেই পুরুষতন্ত্র সব ‘সমস্যার স্তূপ’ করে। কথাটা আপাতদৃষ্টিতে কটূ শোনালেও আসলে নারীকে ‘সমস্যার স্তূপ’ করে তোলা হয়! সেখানে যুক্ত হয় পরিবার-সমাজ-মোড়লতন্ত্রও। নারীর স্বাভাবিক জীবন-পড়াশোনা-চলাফেরা কোনোটাই যেন পরিবার-সমাজ সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি! ঘরেই যে বৈষম্যের সূত্রপাত, সেটা থেকে যায় পড়াশোনা থেকে শুরু করে কর্মস্থলেও! কোথাও নারীর মুক্তি ঘটেনি আজও! সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, বর্তমান যুগে এসেও নারীকে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বেশিরভাগেরই ধারণা, নারীরা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেই সংসার-সন্তান লালন-পালনের উদ্দেশ্যে! তার জীবনের আর কোনোই উদ্দেশ্য-লক্ষ্য-আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে না। সন্তান-সংসার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কিন্তু সমগ্র জীবন নয়! এমন প্রকৃত সত্য উপলব্ধি না করার কারণেই নারীকে শিক্ষা থেকে দূরে রাখা হয়েছিল বহুদিন। কিন্তু সে যুগের পরিবর্তন ঘটেছে। তবে আজও নারীর উচ্চশিক্ষাকে কেন্দ্র করে ধোঁয়াশা কাটেনি!
নারীর উচ্চশিক্ষার পথে বাধা স্বয়ং বাবা-মা! তাদের মত-পথকেই সন্তানের ওপর চাপিয়ে দিতে সদাসর্বদা প্রস্তুত থাকেন তারা! অথচ উচ্চশিক্ষার ব্যাপারটা যদি একজন ছেলের ক্ষেত্রে হয়, তবে বাবা-মা আরও একধাপ বেশিই গর্বে বুক ফুলিয়ে সেটাকে সমাজে বলে বেড়ান। কিন্তু মেয়ে! সে তো ভিন্ন! পড়াশোনার গণ্ডি কোনোরকম পার করে বাবা-মায়ের একটাই চিন্তা মেয়েকে পাত্রস্থ করা! এক্ষেত্রে নারীর বয়স তাদের ও সমাজের কাছে একটি বিশেষ বিষয়!
সমাজের প্রচলিত ধারণা একটা সময় পর্যন্ত নারী সুদর্শনা। তাই শিক্ষার প্রচলিত গণ্ডিটুকু উৎরে গেলেই নারীর বহু বিদ্যে শিক্ষা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়! অধিকাংশ মা-বাবাই তাই মেয়ের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মত দেন না। বরং নারীরা যদি বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করে, তবে তাদের সামনে একটা মুলো ঝুলিয়ে দেওয়া হয়! বলা হয় বিয়ে হলে স্বামী যদি চায়, তবেই সে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এগুতে পারবে নতুবা নয়! এক্ষেত্রে নারীর নিজস্ব মত বাবা-মা সমাজবেত্তাদের যুক্তির কাছে ধোপে টেকে না।
পরিবার-স্বামীর সঙ্গে ব্যাপক লড়াই করে উচ্চশিক্ষার পথে অগ্রগামী মেয়েটি থমকে দাঁড়ায় যখন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক নারী হাল ছেড়ে দিয়ে দিব্যি সংসারে মন দেন। আবার অনেক লড়াকু নারী দেখে নেওয়ার প্রতিজ্ঞায় নিজেকে বলীয়ান করে তোলেন। ফলে যাদের কপালে উচ্চশিক্ষার রাজটিকা লাগে, তারা পরিবার-সমাজ এমনকি যার অধীনে কাজ করবেন, তার সঙ্গেও রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়!
উচ্চশিক্ষা, বিশেষত গবেষণা ক্ষেত্রে নারী হলে প্রথম সমস্যা পরিবার-পরিজন থেকে, দ্বিতীয় সমস্যা তত্ত্বাবধায়ক পাওয়া! পুরুষের ক্ষেত্রে যতটা সহজ একজন নারীর ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই কঠিন! সুপারভাইজার সংকটে নারীর মনে অতিরিক্ত প্রেসার পড়ে! নারীরা তাদের সর্বোচ্চটা দিতে পারেন না জাতিকে! উচ্চতর ডিগ্রিকে অনেকেই সওদায় নিয়ে আসতে চান! এক্ষেত্রে নারীরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকারও হন! একে তো বাবা-মা -স্বামীর কাছ থেকে জোর করে অধিকার আদায় করার চেষ্টা, তার ওপর সুপারভাইজারের কাছে বিভিন্নভাবে শোষিত হন! তাই নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষা হুমকিস্বরূপও বটে! সবকিছুর পর সমাজবেত্তারা তো আছেনই! পান থেকে চুন খসলেও যাদের আপত্তি! নারীর কিঞ্চিৎ ত্রুটিকে ফোকাস করতে তাদের জুড়ি মেলা ভার! নারী শিক্ষাকেই যারা বিভিন্ন দোষে দোষী করে তোলেন, তারা কোনো রকম ত্রুটি পেলে নারীর জীবনকে আরও অতিষ্ঠ করে তোলেন! এসব ভাবনার সঙ্গে নারীকে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেন না। তাই বর্তমান যুগে এসেও উচ্চশিক্ষায় নারীরা এতটা পিছিয়ে!
নারীর জীবনকে সুন্দর-পরিশীলিত করে তুলতে পারি আমরা নিজেরাই। পুরুষের অংশগ্রহণের পাশাপাশি নারীকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার হতে হবে। সত্যের পথে নিজের মনের শক্তি দিয়ে আলো জ্বালাতে হবে। রবীন্দ্রবাণী ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে/ তবে একলা চলোরে’র সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনকে আলোকিত করে তোলাই যেন নারীর চলার পথের পাথেয় হয়, তাহলে নারী আর কারও মুখাপেক্ষী হবে না। বরং ‘একলা চলো’নীতিতে ‘আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে’ নিজের পথকে কুসুমাস্তীর্ণ করে তুলতে পারবে। সব অন্ধকার অপশক্তিকে ছেঁকে নিজের জন্য বরাদ্দ রাখবে শ্রেষ্ঠ পথটি! যে পথেই নারীর প্রকৃত মুক্তি।