নারী সুরক্ষা, সুনীতা উইলিয়ামস ও সমানাধিকারের আকাশছোঁয়া লড়াই
দৃশ্য এক
২৮৬ দিন মহাকাশে কাটিয়ে অ্যামেরিকার সময় অনুযায়ী মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ পৃথিবীর বুকে নেমে আসেন সুনীতা উইলিয়ামস৷ যে পৃথিবী থেকে আটদিনের জন্য মহাকাশে পাড়ি দিতে গিয়ে নিতান্ত নিরুপায় হয়ে প্রায় তিনশ দিন কাটিয়ে আসেন এক মেয়ে, সেই পৃথিবীর আলো বাতাসের অধিকার পেয়েও জন্মের ছাড়পত্র পায় না লক্ষাধিক শিশুকন্যা৷ পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে প্রায় ৯০ লক্ষ কন্যা ভ্রূণ হত্যা হয়েছে ভারতবর্ষে৷
দৃশ্য দুই
২০২৪ এর ৮ আগস্ট মধ্যরাতে কলকাতার আরজি কর মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত নারী ডাক্তারের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর নারী সুরক্ষা নিয়ে এক অভাবনীয় প্রস্তাব পেশ করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার৷ ওই সুরক্ষা কার্যক্রমে মহিলাদের ১২ ঘণ্টার বেশি ডিউটি না দেওয়া এবং রাতের শিফট থেকে বিরত রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়৷ সুপ্রিম কোর্ট সহ বিভিন্ন মহল থেকে এই বৈষম্যমূলক নীতির তীব্র সমালোচনার পর বাতিল হয় ওই দুই নির্দেশ৷
নারীদের প্রতি বৈষম্য, অসম্মান এবং আক্রমণের বাস্তবতা বিশেষ কেউই অস্বীকার করেন না৷ একথাও অস্বীকার করার কোনও অবকাশ নেই যে কেবলমাত্র উপমহাদেশেই নয়, নারী সুরক্ষা ও সম্মান বিপর্যস্ত হয়ে চলে সারা পৃথিবীতেই৷ প্রতিদিন৷ তবে উপমহাদেশের খানিকটা সামন্ততান্ত্রিক সমাজ কাঠামো, ঐতিহ্য, পরম্পরা এবং অনুশাসনের ডামাডোলে নারী স্বাধীনতার সংজ্ঞা পর্দার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়৷ এখানে এখনো বিভিন্ন মহলে ‘নারীবাদ’ শব্দটির প্রতি উষ্মামিশ্রিত অবজ্ঞা আছে৷ তবে পরিসংখ্যানের চিত্রটা দেখলে হয়ত এই মানসিকতা বদলাতে পারে৷

নিপীড়নের খতিয়ান
ভারতে জাতীয় মহিলা কমিশন ২০২৪-এ মোট অভিযোগ পেয়েছে ২৫ হাজার ৭৪৩টি৷ তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, ওই বছর কমিশনে আসা সমস্ত অভিযোগের মধ্যে ২৪ শতাংশই গার্হস্থ্য সহিংসতার৷ বিয়েতে পণ দেওয়াকে কেন্দ্র করে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৭ শতাংশ৷ ২৯২ জন মহিলা পণের কারণে মারা গেছেন৷
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখা যাক৷ ইউএনএফপিএ-র ২০১৯ থেকে ২০২১-এর পরিসংখ্যান বলছে খোদ পশ্চিমবঙ্গে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সি নারীদের মধ্যে প্রায় ৪২ শতাংশ মহিলার বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়স ছোঁয়ার আগেই৷ দেশে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধের আইন রয়েছে এবং একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন পশ্চিমবঙ্গে বাল্য বিবাহ দেশের অন্যান্য বেশ কয়েকটি রাজ্যের তুলনায় কম৷ তাতে এই পরিসংখ্যানের অস্বস্তি কমে না৷
বৈষম্যের অদৃশ্য ক্ষত
তবে গার্হস্থ্য সহিংসতা তো চোখে দেখা যায়৷ আর যে বৈষম্য চোখে দেখা যায় না? ভারত সরকারের মহিলা শ্রমিক সংক্রান্ত ফিমেল লেবার ইউটিলাইজেশান রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩-এ দেশে ১৫ বছরের ওপরে মহিলাদের মধ্যে ৩২ দশমিক আট শতাংশ মহিলা দেশের শ্রমশক্তি বা লেবার ফোর্সে যুক্ত হন৷ পুরুষদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৮১ দশমিক আট৷ ২০২২-এর ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট অনুযায়ী, শ্রমের বিনিময়ে উপার্জিত অর্থের ৮২ শতাংশ পান পুরুষেরা৷ সেই তুলনায় মহিলারা পান ১৮ শতাংশ৷
একথা সত্যি, পরিসংখ্যান বাস্তব চিত্রটা পরিবেশন করলেও পরিবর্তনের আলো জ্বালতে আরো অনেক পরিশ্রম করতে হয়৷ নারী অসম্মানের যে বাস্তব পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না তার ভার বহুলাংশে বেশি৷ বিগত বেশ কয়েক দশক ধরে অনেকাংশেই মহিলাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করার চেষ্টা চলেছে৷ তার ফলও এসেছে হাতে নাতে৷ নারীরা অনেকাংশে স্বাধীন হয়েছেন৷ কখনো চেতনায়, কখনো অর্থনৈতিক ভাবে৷
কিন্তু বিপদ হয়েছে অন্য৷ বহুক্ষেত্রে নারীরা স্বাধীনতা পেলেও স্বাধীন নারীকে সমাজে কীভাবে জায়গা দিতে হয় সে বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাননি কেউ৷ ফলে সমাজের সামগ্রিক নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে৷ হিংসার ঘটনা বেড়েছে৷ কলেজ প্রণয় হোক অথবা গার্হস্থ্য জীবন – সর্বত্র বেড়েছে মানসিক পীড়ন, গ্যাসলাইটিং-এর মতো ঘটনা৷ শহরের মধ্যবিত্ত গলিঘুঁজিতে নিঃশব্দে ঘটে চলা গৃহবধূর উপর মানসিক নিপীড়ন পরিসংখ্যানে ধরা না পড়লেও জেনারেশানাল ট্রমার প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ায়৷ বাড়ির সন্তান মায়ের উপর অত্যাচারের সাক্ষী থাকলে ভবিষ্যৎ জীবনে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য৷
নারী স্বাধীনতা ও অর্থনীতির ইতিহাস
আসলে, নারীর প্রতি অসম্মানের দীর্ঘ ইতিহাসকে কেবলমাত্র সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখলে খামতি থেকে যাবে৷ এর পিছনে রয়েছে অর্থনীতিও৷ নারী স্বাধীনতার দর্শনকে নিজের প্রয়োজনে বার বার ব্যবহার করেছে বাজার অর্থনীতি৷ নারীবাদও, বিশেষ করে সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজম, খোলা বাজার অর্থনীতির হাতের পুতুলের মতো আচরণ করেছে বহু ক্ষেত্রেই৷ সেই কারণেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমানাধিকারের যে লড়াই ভোট দেওয়ার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া থেকে শুরু হয়েছিল ৭০ বা ৮০-র দশকে তার মুখ ঢেকে গেল বিজ্ঞাপনে৷
সামাজিক স্বীকৃতির সেকাল ও একাল
উপমহাদেশের চরিত্র খানিক আলাদা৷ ৬০ এবং ৭০-এর দশকের পপুলার কালচারে, বিশেষ করে বাসু চট্টোপাধ্যায়, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় বা সাই পারাঞ্জপের মিডল-অফ-দ্য-রোড ছবিগুলিতে সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নারী চরিত্র দেখা যেতে লাগল৷ সমাজের বাস্তব চিত্রে এর ব্যাপক প্রভাব না পড়লেও স্বাধীন নারীর প্রতি সম্মানের একটা সামাজিক স্বীকৃতি ছিল৷
৯০-এর দশকের খোলা হাওয়ায় সেই অবস্থার অবনতি হয়৷ তবে নারীর প্রতি হিংসা নিয়ে প্রকৃত অর্থে ব্যাপক আলোচনা ঘটে ২০১২-এ দিল্লিতে নির্ভয়ার নৃশংস ধর্ষণ এবং খুনের পরে৷ সরকার বাধ্য হয় নারী নিরাপত্তার পুরনো আইন পালটে নতুন আইন আনতে৷
এমন নয় যে এর ফলে ভারতে ধর্ষণ বা হিংসা শেষ হয়ে গেছে কিংবা নিদেনপক্ষে কমেছে৷ ২০১৮-র একটি সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ১৫ মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষিতা হতেন এই দেশে৷ তবে নারী সুরক্ষা নিয়ে আলোচনা বেড়েছে৷ নারীবাদের তত্ত্ব আগের তুলনায় অনেক বেশি সামাজিক মান্যতা পেয়েছে৷ তৃণমূল স্তরে না পৌছলেও নতুন প্রজন্ম নিজেদের অধিকার নিয়ে আগের থেকে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে৷ সচেতনতার ছোঁয়া লেগেছে বিজ্ঞাপনে, সিনেমায়, গানে৷ সবথেকে বড় কথা, গণমাধ্যমে নারীদের প্রতি অসম্মানের চিত্র ধরা পড়লে তার প্রতিবাদ করছেন অন্তত কিছু মানুষ৷ সেটাই বা কম কী?
সুনীতা উইলিয়ামসরা একদিনেই মহাকাশ ছোঁয়ার অধিকার পাননি৷ তার পিছনে রয়েছে সমানাধিকারের জন্য লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাস৷ সেই পথ পেরিয়ে একদিন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে৷ লেখার শুরুতে সুনিতার ঘরে ফেরার গানের উল্লেখ করেছিলাম সমাজের তীব্র বৈপরীত্য বোঝাতে৷ শেষে তাকে ফিরিয়ে আনি একটুকরো আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দিয়ে৷ বাস্তব রূঢ়৷ পরিসংখ্যান মন ভেঙে দেয় প্রতিদিন৷ তবু দিন বদলের স্বপ্নটুকু থাক৷ এক দিনে হবে না৷ কিন্তু একদিন হবেই৷