Skip to content

দর্জিপাড়ায় ঈদের ব্যস্ততা

মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুটি ঈদ। এক মাসের সিয়াম সাধনার পরে আসে ঈদুল ফিতর আর কুরবানির জন্য ঈদুল আযহা। বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর মানেই নতুন জামাকাপড়, সাজসজ্জা আর আনন্দের এক বিশাল উৎসব। এই আনন্দের পিছনে নিরলস পরিশ্রম করে যান দর্জিরা। সারা বছর ধরেই কমবেশি কাজ থাকলেও রমজান মাস এলেই দর্জিপাড়ায় শুরু হয় এক অন্যরকম ব্যস্ততা। পোশাক তৈরির শেষ মুহূর্তের তোড়জোড়, রাতভর মেশিনের শব্দ আর গ্রাহকদের চাপ সামলাতে দর্জিদের দিন-রাত এক করে কাজ করা, সব মিলিয়ে ঈদ সামনে আসলেই দর্জিপাড়ার এক ব্যস্তচিত্র তৈরি হয়।

রমজান মাসে দর্জিদের ব্যস্ততা
ঈদের পোশাক তৈরির প্রস্তুতি সাধারণত শবে বরাতের পর থেকেই শুরু হয়। অনেকে আগেভাগেই কাপড় কিনে দর্জিদের কাছে দিয়ে যান। এতে সময়মতো জামা-কাপড় প্রস্তুত হয়। তবে বেশিরভাগ মানুষ রমজানের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে পোশাক বানানোর জন্য অর্ডার দেন আর তখনই মূল ব্যস্ততা শুরু হয়।
শহর ও গ্রাম নির্বিশেষে সব দর্জিপাড়াতেই কাজের চাপ বেড়ে যায়। ঢাকার নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, ইসলামপুর, চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার, রাজশাহী, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দর্জির দোকানগুলোতে রাতদিন সমান তালে কাজ চলে। রমজানের মাঝামাঝি সময়ে কাজ এতোটাই বেড়ে যায় যে, দর্জিরা ঘুমানোরও সময় পান না।

গ্রাহকদের চাহিদা ও পোশাকের ধরন
ঈদ মানেই নতুন জামাকাপড়, আর ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে প্রত্যেকেই চায় তাদের পোশাক হোক একেবারে নিখুঁত। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ডিজাইনার পোশাকের চাহিদা বেশি থাকে। নারী-পুরুষ উভয়ের পোশাকের মধ্যে বিভিন্ন ডিজাইন যুক্ত করার প্রবণতা দেখা যায়। মেয়েরা সাধারণত সালোয়ার-কামিজ, লেহেঙ্গা, শাড়ি ও গাউন তৈরি করান। অন্যদিকে ছেলেরা পাঞ্জাবি, পায়জামা, কোট ও শার্ট-প্যান্ট তৈরি করান। শিশুদের পোশাকেও থাকে নানা বৈচিত্র্য।
সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে মানুষ ট্রেন্ড অনুসরণ করে পোশাক বানাতে চায়। ফলে দর্জিদেরও সেই নতুন ডিজাইন শিখতে ও তৈরি করতে বাড়তি সময় দিতে হয়। ঈদের সময়ে অনেক দর্জিরা বিভিন্ন ডিজাইনের কাটিং ও সেলাইয়ের জন্য বাড়তি কারিগর নিয়োগ করেন।

কাজের অতিরিক্ত  চাপ
রমজানের সময় সাধারণত দর্জিদের দোকানগুলো ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। দিনের বেলা রোজা রেখে কাজ করা কঠিন হলেও তাঁরা কাজ চালিয়ে যান। ইফতারের পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজের চাপ থাকে সবচেয়ে বেশি। অনেক দর্জি তাদের পরিবারের সঙ্গেও ঠিকমতো ইফতার ও সেহরি করতে পারেন না। এমনকি অনেক সময় ঈদের আগের দুই-তিন দিন একেবারেই ঘুমানোর সুযোগ পান না তাঁরা।
অনেক দোকানে গ্রাহকদের চাপ এত বেশি থাকে যে, অনেক দর্জি বাড়িতে নেওয়া অর্ডার শেষ করতে পারেন না। শেষ মুহূর্তে পোশাক হাতে না পেয়ে অনেক গ্রাহক রাগান্বিত হন এমনকি কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে। তাই ঈদের আগে দর্জিরা চাপের মুখে থাকেন এবং অনেক সময় অতিরিক্ত সময় কাজ করার জন্য সহকারী বা অতিরিক্ত কর্মচারী রাখেন।

ঈদুল ফিতর ও দর্জিদের আনন্দ
ঈদ মানেই সবাই আনন্দ করে। কিন্তু দর্জিদের ঈদ হয় একটু ভিন্নভাবে। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত তাঁরা কাজে ব্যস্ত থাকেন ফলে নিজেদের জন্য কেনাকাটা করার সময়ও পান না অনেকেই। এমনকি অনেক দর্জি শেষ মুহূর্তে নিজের বা পরিবারের পোশাক তৈরি করতে পারেন না।
তবে ঈদের দিন দর্জিরাও ছুটি পান এবং পরিবারের সাথে আনন্দ করেন। অনেকেই ঈদের নামাজ পড়ার পর দিনভর ঘুমিয়ে কাটান। কারণ টানা কাজের ধকল সামলাতে হয় তাঁদের। তবে একদিকে ক্লান্তি থাকলেও অন্যদিকে তাঁদের মনেও আনন্দ থাকে যে তাঁরা অসংখ্য মানুষের ঈদের খুশিতে অংশ নিয়েছেন।

উপার্জনের দিক থেকে দর্জিদের ঈদ
ঈদ উপলক্ষে দর্জিদের আয় বাড়ে। সারা বছর কাজ কম থাকলেও রমজান মাসে তাঁরা অতিরিক্ত উপার্জন করতে পারেন। সাধারণত প্রতিটি পোশাক তৈরির জন্য অতিরিক্ত চার্জ নেওয়া হয় বিশেষ করে যদি তা জরুরি ভিত্তিতে তৈরি করতে হয়। অনেক দর্জিরা এই সময়ে দ্বিগুণ বা তিনগুণ উপার্জন করেন যা তাঁদের বছরের অন্যান্য সময়ের জন্য আর্থিকভাবে সহায়ক হয়।

তবে ছোট দর্জি দোকান বা গ্রামে যারা কাজ করেন, তাঁদের উপার্জন শহরের তুলনায় কম থাকে। আবার কেউ কেউ কাজ বেশি হলেও প্রতিযোগিতার কারণে বেশি দাম নিতে পারেন না। ফলে অতিরিক্ত পরিশ্রম করেও প্রত্যাশিত অর্থ উপার্জন করতে পারেন না।

বর্তমানে বড় ব্র্যান্ড ও তৈরি পোশাকের দোকানগুলো ঈদের সময় বিভিন্ন নতুন ডিজাইনের পোশাক বিক্রি করে। ফলে অনেকেই দর্জির দোকানে পোশাক বানানোর পরিবর্তে প্রস্তুত তৈরি পোশাক কিনতে পছন্দ করেন। এতে ছোট দর্জি দোকানগুলোর ব্যবসা কিছুটা হুমকির মুখে পড়েছে।
তবে যাঁরা কাস্টমাইজড পোশাক তৈরি করেন, তাঁরা এখনও ভালো ব্যবসা করেন। নতুন ডিজাইন, নতুন কৌশল ও আধুনিক মেশিন ব্যবহার করে অনেক দর্জিরা তাঁদের ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখছেন।

ঈদ মানেই শুধু উৎসবই নয়, এটি দর্জিদের জন্য পরিশ্রম, ধৈর্য, এবং সৃজনশীলতার পরীক্ষার সময়। তাঁরা নিজেরা পরিশ্রম করে অন্যদের জন্য ঈদের আনন্দ নিশ্চিত করেন। যদিও তাঁদের ঈদ অন্যদের মতো আনন্দময় নয়, তবে তাঁরা জানেন যে তাঁদের কাজের জন্য হাজারো মানুষ খুশি হয়। তাই দর্জিদের ঈদ মানে আত্মত্যাগের আনন্দ, ক্লান্তির মাঝেও এক ধরনের পরিতৃপ্তি।