হরমোনজনিত সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ও করণীয় পরামর্শ
নারীদের জীবনজুড়ে হরমোনের এক বিস্তৃত ভূমিকা থাকে। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু করে প্রজনন, গর্ভাবস্থা, স্তন্যদান এবং মেনোপজ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই হরমোন দেহ ও মনের কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। তবে হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে নারীরা বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হন। দুঃখজনকভাবে, এসব সমস্যার অনেকটাই অজ্ঞাত থাকে, ফলে সময়মতো সমাধান না পাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। তাই হরমোন এবং এর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত জানা ও সচেতনতা অর্জন অত্যন্ত জরুরি।
হরমোন কী এবং এর কার্যপ্রক্রিয়া
হরমোন হলো শরীরের গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত এক বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। এটি রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রবাহিত হয়ে সেগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস, পিটুইটারি, থাইরয়েড, প্যারাথাইরয়েড, অ্যাড্রেনাল, ওভারি প্রভৃতি গ্রন্থি থেকে প্রতিনিয়ত হরমোন উৎপাদন হয়। হরমোন আমাদের বৃদ্ধি, বিপাকক্রিয়া, প্রজনন এবং মানসিক স্থিতিশীলতার উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
হরমোনজনিত সমস্যার কারণ
হরমোনজনিত সমস্যাগুলো সাধারণত দুটি প্রধান কারণে হয়:
১. প্রয়োজনের তুলনায় কম হরমোন উৎপাদন।
২. প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত হরমোন উৎপাদন।
এছাড়াও, গ্রন্থির সংক্রমণ, প্রদাহ, টিউমার বা ক্যানসার হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। কিছু নির্দিষ্ট অটোইমিউন রোগ, যেমন হ্যাশিমোটো থাইরয়েডিটিস বা গ্রেভস ডিজিজ, হরমোনজনিত জটিলতার মূল কারণ হতে পারে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা, রাত জাগা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এ সমস্যাগুলোর ঝুঁকি বাড়ায়।
নারীদের সাধারণ হরমোনজনিত রোগ ও সমস্যা
থাইরয়েডজনিত সমস্যা
থাইরয়েড হলো গলার সামনের দিকে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি। এটি থেকে নিঃসৃত হরমোন শরীরের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং বিপাকক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে।
- হাইপোথাইরয়েডিজম (হরমোন ঘাটতি): ওজন বৃদ্ধি, শুষ্ক ত্বক, চুল পড়া, ক্লান্তি, অতিরিক্ত ঘুম, অনিয়মিত মাসিক এবং বন্ধ্যত্বের মতো সমস্যা সৃষ্টি করে।
- হাইপারথাইরয়েডিজম (হরমোনের আধিক্য): ওজন কমে যাওয়া, ডায়রিয়া, বুক ধড়ফড়, ঘাম হওয়া এবং মাসিক বন্ধ হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়।
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (পিসিওএস)
পিসিওএস হলো কিশোরী ও তরুণীদের মধ্যে দেখা দেওয়া একটি সাধারণ সমস্যা। এটি পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে হয়। ফলে মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায়, মুখে ব্রণ দেখা দেয়, চুল পড়ে, অবাঞ্ছিত লোম গজায় এবং স্থূলতা বাড়ে। পিসিওএস বন্ধ্যত্বের কারণও হতে পারে।
অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির সমস্যা
কিডনির ওপরে থাকা অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে কর্টিসোল, অ্যালডোস্টেরনসহ বিভিন্ন হরমোন উৎপন্ন হয়।
- অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিতে টিউমার বা প্রদাহ হলে মুখ ফোলা, পেটের চারপাশে চর্বি জমা, রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং মাসিক অনিয়মিত হওয়ার মতো সমস্যাগুলো দেখা দেয়।
- হরমোন কম উৎপাদিত হলে অ্যাডিসন ডিজিজ দেখা দিতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি, ওজন হ্রাস, রক্তচাপ কমে যাওয়া এবং লবণের ঘাটতির মতো সমস্যা হয়।
ডায়াবেটিস
নারীদের মধ্যে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস একটি বিশেষ সমস্যা। এটি সাধারণত গর্ভাবস্থায় দেখা দেয় এবং সন্তান প্রসবের পর সেরে যায়। তবে ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
অস্টিওপোরোসিস
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায়। এটি মূলত মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেন হরমোনের ঘাটতির কারণে ঘটে। কৈশোর থেকে ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
মেনোপজ
৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সে নারীদের মেনোপজ হয়। এই সময় হট ফ্লাশ, ঘাম হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, ইনসমনিয়া এবং ক্লান্তির মতো উপসর্গ দেখা দেয়। এ সময় স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অত্যন্ত জরুরি।
হরমোনজনিত সমস্যার প্রতিরোধ ও সমাধান
নারীদের উচিত হরমোনজনিত পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।
১. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: তাজা শাকসবজি, ফলমূল এবং ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন।
২. নিয়মিত ব্যায়াম: শারীরিক পরিশ্রম এবং যোগব্যায়াম হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৩. পর্যাপ্ত ঘুম: রাতে ভালো ঘুম মানসিক চাপ কমায় এবং শরীরকে সুস্থ রাখে।
৪. চিকিৎসকের পরামর্শ: সমস্যার উপসর্গ দেখা দিলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
সচেতনতা জরুরি
নারীদের জীবনের প্রতিটি ধাপেই হরমোনের প্রভাব থাকে। তাই নিজের যত্ন নেওয়া, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের সমস্যাগুলো মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকা এবং সুস্থ জীবনযাপন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন এনে আপনি হরমোনজনিত সমস্যাগুলোকে প্রতিরোধ করতে পারবেন।
ডা. তানজিনা হোসেন, অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ