Skip to content

১৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | মঙ্গলবার | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারী বনাম মহিলা বিতর্ক

নারী ও মহিলা। এই দুটো শব্দের ব্যবহার নিয়ে মতভেদ দেখা যাবে। কোন শব্দটি ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে বিতর্ক আছেই। কারণ এই দুটো শব্দের ব্যবহার করে এমন অনুসারী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে। কেউ মনে করেন, আধুনিক সময়ে নারী বললেই নিরপেক্ষ অবস্থানে বিচার করা যায়। নারী শব্দটির মধ্যে কমনীয় ও নিরপেক্ষতার যে অচি পাওয়া যায় তা মহিলাতে বিলুপ্ত থাকে। আবার দেশে মহিলা শব্দটিই বেশি জনপ্রিয়। ত্রিশোর্ধ্ব যে কাউকেই মহিলা সম্বোধন করা হয়। বিশেষত ভাষাতে এর ব্যবহার সমাজের সব পর্যায়েই এক রকম। নারী নাকি মহিলা, বিতর্কের সূত্রপাত মূলত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ‘মহিলা’ শব্দটির ব্যবহারের মাত্রা দেখে। প্রাতিয়ানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক সব পর্যায়েই মহিলা শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়। এর পেছনে ভাষার সূক্ষ্ম বিচারবোধ রয়েছে ভাবলে ভুল করা হবে। বরং সাংস্কৃতিক অবয়বে বিষয়টিকে বিচার করতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিকে সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন নানাভাবে বিচার করে। একে বলা হয় পপুলার কালচার। ভাষার ব্যবহার ও দৈনন্দিন জীবনে এর প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে শব্দকে একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে ফেলা হয়। একবার ভেবে দেখুন, ব্যক্তি শব্দটি বললে সচরাচর নারী ও পুরুষ দুজনকেই বোঝানোর কথা। কিন্তু ব্যক্তি উল্লেখ করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষকে কল্পনা করা হয়। ভাষার এই ব্যবহার শব্দের অর্থকে বৈচিত্র্য দিতে পারে। আমরা অবচেতনে ভাষ্যকে ব্যবহার করে বৈষম্যের পারদ গড়ে তুলতে পারি। বৈষম্য একটি বিমূর্ত ধারণা। এই বিমূর্ত ধারণাকে রূপায়ন দেয়ার মাধ্যমে সমাজে আচার ও নিষ্ঠা গড়ে ওঠে।

আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে মানুষ যে সংস্কৃতি গড়ে তোলে তাকে বলা হয় ফোকলোর। এই দুটো ক্ষেত্রেই নারী ও মহিলা শব্দের মধ্যে মহিলা শব্দের আধিপত্য বেশি। নারী শব্দটি যেন শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীদের জন্য প্রযোজ্য। বিশেষত তরুণীদের নারী শব্দটির সঙ্গে মানানসই করে ভাবা হয়। অপরদিকে মহিলা শব্দটি ঢালাওভাবে ব্যবহৃত হয় গ্রামীণ অঞ্চলে, অশিক্ষিত বা পিছিয়ে পড়া নারীদের বোঝাতে এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যারা শ্রম বিক্রি করেন তাদেরও। এই যে নারী ও মহিলা শব্দের ব্যবহারের ব্যাপ্তি এটি নিয়ে বিতর্ক করা কেন জরুরি? এ কথা সত্য, কে কোন ভাষা ব্যবহার করবে তা মানুষ নির্ধারণ করে দিতে পারে না। মানুষের বলার স্বাধীনতা রয়েছে এবং ভাষার গণ্ডিতে আইন বা প্রশাসনিক নিয়ম কখনই প্রবেশ করা উচিত নয়। পৃথিবীর সব স্বৈরশাসকই ভাষাকে তার যুক্তিবাক্যের আযার হিসেবে ব্যবহার করার পেছনেও কারণ রয়েছে। ভাষাকে ব্যবহার করে মনোজগৎ ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ আনা যায়। আর প্রচলিত শব্দের অর্থ বিচার করলে আমরা সমাজ ও সংস্কৃতির কালবেলাও আবিষ্কার করতে পারি। নারী ও মহিলা শব্দের ব্যবহারেও এই ব্যবহারিক পরিবর্তনের প্রয়োগ রয়েছে।

দেশের সরকারি দফতর বা বিভাগ অথবা সংস্থাগুলোয় ‘মহিলা’ শব্দটি বেশি ব্যবহৃত। যেমন- মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিলা বিষয়ক অধিদফতর, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, মহিলা পুলিশ, মহিলা কলেজ, মহিলা হোস্টেল ইত্যাদি। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় বা বস্তুগত সংস্কৃতিতে মহিলা আসন গেড়ে বসে আছে। অন্যদিকে বিমূর্ত বা প্রগতিশীল যার সঙ্গে শিক্ষা ও সংহতি জড়িত সেখানে নারীর ক্ষমতায়ন, নারী নির্ঘাতন আইন, নারীর অর্থায়ন, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি এসব ভাবনা প্রকাশ করা হয়। নারী ও মহিলা শব্দ দুটিকে সমার্থক হিসেবে বিচার করা জরুরি। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ গ্রন্থে খুব একটা পার্থক্য দেখা যায় না এ দুটির শব্দের। সেখানে ‘মহিলা’ শব্দের অর্থ লেখা আছে- সম্ভ্রান্ত নারী, যে কোনো নারী বা স্ত্রীলোক। অন্যদিকে ‘নারী’ শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে- স্ত্রীলোক, রমণী, মহিলা, পদ্মী।

ভাষা বিজ্ঞানীদের অনেকে মনে করেন, ‘মহিলা’ শব্দটি এসেছে মহল থেকে। ফলে নারীদের মহিলা নামে ডাকা মানে তাদের মর্যাদাহানি ঘটানো। আবার কেউ কেউ বলছেন, অনেকদিন আগে থেকে মহিলা শব্দটি ব্যবহার করতে করতে এটির প্রচলন অনেকটাই বেড়ে গেছে। কিন্তু নারী শব্দটি বেশি মর্যাদাকর। ‘মহল’ শব্দটি আরবি। আর ‘মহিলা’ শব্দটি সংস্কৃত। যা ‘মহ’ ধাতু থেকে এসেছে। যার অর্থ ‘মহৎ’ কিংবা ‘মহতী’। সুতরাং আরবি ‘মহল’ শব্দ থেকে ‘মহিলা’ শব্দটি এসেছে। এই ধারণা ঠিক নয়। বরং ‘নারী’ শব্দটিই এসেছে ‘নর’ এর স্ত্রী লিঙ্গ বোঝাতে।

মহিলা শব্দটির অর্থ বিষয়ে অনেকের মতামত ইতিবাচক হিসেবেও পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন, মহিলা শব্দটি সম্ভ্রান্ত স্ত্রী ব্যক্তিকে বোঝায়। কিন্তু যেমনটি বলেছি, মহিলা শব্দটি প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক দুটো ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের কিছু উদাহরণ দেয়া হয়েছে আগে। এবার আরেকটি বিশ্লেষণাত্মক উদাহরণ দেয়া যায়। সাহিত্য কবি সম্বোধনের সময় অতীতে ‘মহিলা কবি’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত ছিল। এর পেছনে সামাজিক কারণ রয়েছে। কারণ অন্দরের নারী শিল্প-সাহিত্যে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেতো কম। মহিলা কবি বল্য মূলত সাহিতো নারীকে সংকীর্ণ অর্থে উপস্থাপন করা। কিন্তু যখন নারী শব্দটি উচ্চারণ করা হয় তখন তার সঙ্গে যোগ্যতার উপস্থাপন ঘটতে বাধ্য। সাক্ষরতা নেই এমন পর্যায়েও নারী শব্দটি ব্যবহৃত হয় যখন তারা দেখে কোনো শিক্ষিত নারী বা স্বাবলম্বী নারী তাদের সামনে এসেছে। অপরদিকে মহিলা শব্দটি ব্যবহার করে সংকীর্ণ উদ্দেশ্য থাকেই। গালাগালি বা সম্বোধনের মাধ্যমেও বিষয়টি দেখা যেতে পারে। সমাজে অনেক সময় ‘বদ মহিলা’ ‘তেজি মহিলা’ ‘দুঃসাহসী মহিলা’ ‘জবরদস্ত মহিলা’ ‘চরিত্রহীন মহিলা’ ‘অসৎ মহিলা’ এই শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়। তেজি শব্দটি ইতিবাচক হলেও মহিলা শব্দের আগে বসায় তা নেতিবাচক রূপ ধারণ করে। অথচ স্বাবলম্বী বা উদ্যোগী নারী বললে তা ইতিবাচক রূপ নেয়।
তাই এই দুটো শব্দের ব্যবহার মূলত দুটো ভিন্ন স্তরে ঘটে। শব্দের ব্যবহার নিয়ে আমরা কোনো নিয়ন্ত্রণের পথে যেতে পারি না। তবে শব্দের ব্যবহারে সমাজে নারীকে সংকীর্ণভাবে উপস্থাপনের প্রবণতা বা অপসংস্কৃতি থামানো সম্ভব। বিষয়টি কঠিন এমন হয়। একসময় অফিসে পুরুষকে স্যার এবং নারীকে ম্যাডাম বলা হতো। এখন ব্যক্তিকে স্যার সম্বোধন করা হয়। এছাড়া আগে সাহিত্যে মহিলা কবি, মহিলা ঔপন্যাসিক ধারণা থাকলেও এখন বদলে গেছে সে ধারণা।

আমাদের সমাজে নারীদের সুযোগ-সুবিধা সীমিত পরিসরে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু নারী যে পুরোপুরি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না তা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে দেখলেই বোঝা যায়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। নারী শব্দটি নিরপেক্ষ হিসেবে দাঁড় হয়। এটি শুধু বাক্তি নয় তার ব্যক্তিত্ব ও প্রস্তুতিকেও ইঙ্গিত করে। তবে সমাজে মহিলা শব্দের আধিপত্য বেশি। আর মহিলা সম্ভ্রান্ত অর্থে ব্যবহৃত হলেও তার পরিসর অনেক কম। বরং নারীকে সংকীর্ণ করার প্রবণতাই থাকে বেশি। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পর্যায়ে এ জন্যই সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ